র‍্যাগিং ঠেকানোর কমিটিতে দলান্ধদের রাখবেন না

বহুদিন থেকেই এ রকম একটি নির্দেশনার অপেক্ষায় ছিলেন সবাই; বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা অধিকাংশ শিক্ষার্থী। ১২ জানুয়ারি দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষত সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধিভুক্ত কলেজে র‌্যাগিংবিরোধী কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। র‌্যাগিংয়ে আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের জরুরি সাহায্য ও দ্রুত প্রতিকার দিতে এই কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।

হাইকোর্টের এই রুলে আরও জানতে চাওয়া হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের জীবন ও মর্যাদা রক্ষায় র‌্যাগিং কার্যক্রম রোধে নীতিমালা প্রণয়নে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না। আদালত আরও জানতে চেয়েছেন, র‌্যাগিং থেকে শিক্ষার্থীদের জীবন ও মর্যাদা রক্ষায় কার্যকর পদ্ধতি প্রবর্তনের নির্দেশ কেন দেওয়া হয়নি বা হবে না? স্বরাষ্ট্রসচিব, শিক্ষাসচিব, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।


নিঃসন্দেহে এটি অত্যন্ত যুগান্তকারী পদক্ষেপ। র‌্যাগিংয়ের মাধ্যমে জুনিয়র শিক্ষার্থীরা, তথা নতুন শিক্ষার্থীরা অবমাননা ও হয়রানির শিকার হন। কনিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা ক্ষেত্রবিশেষ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন, যা শুধু মানবাধিকারের লঙ্ঘনই নয়, বরং মৌলিক অধিকারেরও পরিপন্থী। এগুলোকে আমলে এনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চলমান র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে নীতিমালা তৈরি, র‌্যাগিংবিরোধী কমিটি গঠন ও তদারকির জন্য অ্যান্টির‌্যাগিং স্কোয়াড গঠন ও এ কাজে সার্বক্ষণিক একজন প্রতিনিধি রাখার নির্দেশনা চেয়ে ৮ জানুয়ারি আইনজীবী ইশরাত হাসান একটি রিট আবেদন করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধিভুক্ত কলেজে র‌্যাগিংবিরোধী কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রতিবছরই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়ে বহ শিক্ষার্থী মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তার মধ্যে গত দুই বছরে ২০ জনের মতো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাকে আত্মস্থ করার আগেই অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাগিংয়ের শিকার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে শুরু করেন। যার কারণে তাঁরা নিজেদের ভয়ের এক পৃথিবীর বাসিন্দা হিসেবে ভাবতে থাকেন। অথচ উল্টোটাই হওয়ার কথা; তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেকে মেলে ধরবেন, নিজের মন সাজাবেন, সৃজনশীলতার চর্চা করবেন।

র‍্যাগিংয়ের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি আরও বেশ হতাশার জায়গা তৈরি হয় যখন এই র‍্যাগিং প্রতিকারের বিষয়ে প্রশাসন কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে না এবং র‍্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীর পাশে এসে দাঁড়ায় না। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনাকেই র‍্যাগিং-সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ভাবতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের স্বপ্নটি গোড়াতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

এখন প্রথম কথা হলো, এই নির্দেশনা সব বিশ্ববিদ্যালয় মানছে কি না, সেটি পর্যবেক্ষণ করা দরকার। ২০০৯ সালে হাইকোর্ট যৌন নিপীড়ন রোধে আরেকটি যুগান্তকারী নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেটি ছিল সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি বা সেল তৈরি করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত সব কলেজে দূরে থাক, দেশের ৫২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগই তা করেনি।

দ্বিতীয় বিষয়টা আরও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিংবিরোধী কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক শিক্ষকেরাই বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত আছেন। এখন তাঁরাই যদি পদাধিকার কিংবা দলীয় বিবেচনায় এই র‍্যাগিং কমিটিতে থাকেন, তাহলে এই কমিটি যে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারবে না, তা সাদা চোখেই বলা যায়। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই অল্প কিছু প্রশাসনিক শিক্ষকই মোটামুটি সব কমিটিতে আছেন। তাঁরা একাধিক পদে আছেন এবং তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একধরনের ক্ষমতার সিন্ডিকেট তৈরি করে রেখেছেন। ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার কারণে ন্যায়বিচার করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ, তাঁদের আগ্রহের জায়গা কোনোভাবেই শিক্ষার্থী নয়, বরং ক্ষমতা ও পদই তাঁদের বিবেকবুদ্ধিকে চালিত করে। তাই কোনো ধরনের প্রশাসনিক পদে নেই—এমন শিক্ষকদের কিংবা জ্যেষ্ঠ, মধ্য ও কনিষ্ঠ শিক্ষকদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করা বাঞ্ছনীয়।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]