সীমান্তে মানুষ হত্যা

ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় অবশেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। গত রোববার প্রধানমন্ত্রীর সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, সীমান্তে যাতে একজন মানুষও মারা না যায়, সে ব্যাপারে ভারত অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হচ্ছে সীমান্তে হত্যা ঘটছে। তাই আমরা উদ্বিগ্ন। 

 পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই উদ্বেগ ব্যক্তি বা সরকারের উদ্বেগ নয়। এটি দেশের ১৭ কোটি মানুষের উদ্বেগ। সম্প্রতি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, ২০১৯ সালে বিএসএফের গুলিতে ৩৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন। আগের বছরে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৩। চলতি বছরের প্রথম ১০ দিনে বিএসএফের গুলিতে ঠাকুরগাঁওয়ে একজন ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে দুজন মারা যান। বিএসএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিহতরা চোরাচালানকারী এবং তাঁরা টহলদার জওয়ানদের আক্রমণ করেছিলেন। পাল্টা আক্রমণে তঁারা নিহত হন। বিএসএফের এই ভাষ্য কতটুকু সত্য, তা প্রমাণসাপেক্ষ। ফেলানী নামের কিশোরীটি কাঁটাতার পার হওয়ার সময় বিএসএফের জওয়ানদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। এ রকম ঘটনা আরও এন্তার ঘটছে। 

সীমান্তে চোরাচালান বা পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধ রোধ করা সীমান্তরক্ষীদের দায়িত্ব। এর অর্থ এই নয় যে কাউকে চোরাচালানি বলে সন্দেহ হলেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করতে হবে। প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করেও চোরাচালান দমন করা যায় এবং সেটাই সভ্য দুনিয়ার রীতি। দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের বৈঠকে বহুবার প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না বলে অঙ্গীকার করা হয়েছিল। প্রতিবার বিজিবি ও বিএসএফের বৈঠকের যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়, তাতেও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে না বলে একমত প্রকাশ করা হয়। এসবের পরও সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে একের পর এক মানুষ হত্যার ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। 

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সীমান্তে হত্যা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা দিল্লিকে জানানো হয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে কিংবা আদৌ পাওয়া গেছে কি না, সেটি তিনি জানাননি। সীমান্তে হত্যার ঘটনা চলতেই থাকবে আর বাংলাদেশ উদ্বেগ প্রকাশ করে যাবে—এই বাস্তবতা দুর্ভাগ্যজনক। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে, তা ভারত আমলে নিচ্ছে—এমন কোনো প্রমাণ মিলছে না। ভারত বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও বন্ধুদেশ। দুই দেশের মধ্যে অনেক দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের খাতিরে সীমান্তে হত্যার বিষয়টি ভারতকে আমলে নিতে হবে। দুই দেশের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হবে সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো, আর অন্যদিকে সীমান্ত হত্যা চলতেই থাকবে—এটা বৈপরীত্যপূর্ণ। 

সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুই দেশের সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, সংবাদমাধ্যমের অনেক খবরে নাকি বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। আসলে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা বা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সমস্যাগুলো আড়াল করা, কোনোটিই দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়। সংবাদমাধ্যমের কাজ হচ্ছে কঠিন সত্যকে তুলে ধরা ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ করা। চূড়ান্ত বিচারে তা যেকোনো দেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য সহায়ক হিসেবেই কাজ করে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শীতল না উষ্ণ, তা শুধু মন্ত্রীর বক্তব্য বা সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে বাংলাদেশের উদ্বেগ ভারত কিংবা ভারতের উদ্বেগ বাংলাদেশ কতটা আমলে নিল, তার ওপর।