উন্নয়নের ভূষণ কি বায়ুদূষণ!

আশা করি বায়ুদূষণের খবর মানুষের গা সওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। খারাপ খবর শুনতে শুনতে সেগুলো হজমের ক্ষমতাও মানুষের বাড়ে। বায়ুর মান খারাপের খবরে আমাদের কারও মান যায় না। আমাদের হৃদয়ও বিষাদে ভরে ওঠে না। কিন্তু ফুসফুস ও মস্তিষ্ক যে আক্রান্ত হয়, তা কীভাবে ভুলে থাকা চলে! হৃদয় আক্রান্ত না হলেই যে হৃদ্‌রোগ হবে না, সে গ্যারান্টি তো আর দেওয়া যায় না। বায়ুদূষণ নিয়ে উদাসীন থাকার বিলাসিতায় বেশি দিন গা ভাসানোর সুযোগ হয়তো আমাদের নেই। কারণ, তত দিন পর্যন্ত আমাদের শ্বাসযন্ত্র আর ক্যানসার প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আর সে ব্যাপারে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক সতর্কবার্তাও রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার ভিজ্যুয়াল নামের একটি সংস্থা সারা বিশ্বেরই বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ করে। তাদের পর্যবেক্ষণে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীর তালিকায় থাকছে শীর্ষে। ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোও বায়ুদূষণের মধ্যেই ডুবে থাকে, যা কয়েক বছর আগেও ছিল না।

পরিবেশের ব্যাপারে উদাসীনতা নতুন কোনো ঘটনা নয়। সেটা বৈশ্বিক পরিসর থেকে জাতীয় পর্যায় সবখানেই। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা পৃথিবীর ব্যবসা–বাণিজ্য তদারকির দায়িত্বে আছে। তার পূর্বসূরি ছিল শুল্ক ও বাণিজ্যবিষয়ক সাধারণ চুক্তি (গ্যাট)। আশ্চর্য হতে হয় যে সেই চুক্তির দলিল ঘেঁটে কোথাও ‘পরিবেশ’ শব্দটি পেলাম না। বৈশ্বিক বাণিজ্যের বিভিন্ন ধাপে পরিবেশের ক্ষতি হয়। তা কমিয়ে আনতে ব্যবস্থা নিলে কিছু মুনাফা কমবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই ক্ষতিটুকুও মেনে নিতে নীতিনির্ধারকেরা রাজি ছিলেন না। যাহোক, বর্তমানের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আলোর মুখ দেখেছে ১৯৯৫ সালে। সেখানে অবশ্য টেকসই উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে পরিবেশের কথা বলা আছে। যদিও পরিবেশের চেয়ে বাণিজ্য উদারীকরণ আর মুনাফাই বেশি প্রাধান্য পেয়ে আসছে।

এগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপীই পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিস্থিতি খারাপ। এ বিষয়ে শুরুতে মনোযোগ ছিল না বলেই সংকট ঘনীভূত হয়েছে। তাই উন্নত দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এখন বলছে যে বিনিয়োগ হ্রাস ও বাণিজ্যের গতি কমে যাওয়ার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য। আর তা হলো জলবায়ু আর প্রযুক্তিগত পরিবর্তন। পরিবেশ বাদ দিয়ে শুধু জিডিপি বাড়িয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই মডেল কাজ করছে না। ওইসিডির সতর্কবাণী থেকে তা–ই প্রমাণিত হয়।

মোটা দাগে বায়ুদূষণের উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ইটভাটা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া, আর যথেচ্চার নির্মাণ প্রকল্প। এর বাইরে ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ তো রয়েছেই। এই উৎসগুলো বন্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে সমস্যার প্রতিকার হবে না, সে কথা কারও অজানা নয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর অবৈধ ইটভাটা বন্ধে অভিযান জোরদার করেছে। তবে নতুন অবৈধ ইটভাটা স্থাপনের খবরও থেমে নেই। এমনকি বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়েও ইটভাটার খবর পাওয়া যায়। আবার উচ্ছেদের পরও অনেক ভাটায় ইট পোড়ানো বন্ধ হয়নি।

সড়ক পরিবহনে নতুন আইন হয়েছে সম্প্রতি। সেখানে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে শাস্তির কথা বলা ছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে পরিবহন শ্রমিকনেতারা এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন। সেই আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে লাইসেন্স ও ফিটনেস বিষয়ে কোনো শাস্তি আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।

বায়ুদূষণে প্রতিবছর বাংলাদেশে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ মারা গেছে শুধু বায়ুদূষণজনিত কারণে। তবে শুধু ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় কত মানুষ মারা যাচ্ছে, তার নির্দিষ্ট হিসাব পাওয়া কঠিন। কিন্তু এই ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যুর পেছনে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের দায় রয়েছে। সেটা প্রমাণিত। তার মানে এ বছরও সেই দায় জনগণকে বহন করতে হবে।

এদিকে যথেচ্চার নির্মাণ প্রকল্প বন্ধে ইমারত বিধিমালার বাস্তবায়ন না হওয়ার নজির তো প্রতিদিনই চলতে–ফিরতে দেখছি আমরা। নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র পড়ে থাকা, সেগুলো ঢেকে না রাখা, ঠিকমতো পানি না দেওয়া ইত্যাদি সাদা চোখেও দেখা যায়। আর সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িও থেমে নেই। একেক সেবা সংস্থা একেকবার রাস্তা খুঁড়ছে। আজ সিটি করপোরেশন রাস্তা খুঁড়লে কাল খুঁড়বে ওয়াসা, এরপর দিন হয়তো তিতাস গ্যাস বা বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কিংবা টিঅ্যান্ডটি। এই খোঁড়াখুঁড়ি যদি সমন্বয় করে করা হতো, তাহলে জনভোগান্তি যেমন কমত, বায়ুদূষণও কমিয়ে আনা যেত। এই সমন্বয়হীনতার প্রভাব নাগরিক জীবনকে কীভাবে বিষিয়ে তুলছে, সে খবর রাখার দায় যেন কারও নেই।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলে তাদের দায়িত্ব করণীয় ঠিক করে দেওয়া। আর সিটি করপোরাশন ও রাজউকের দায়িত্ব হলো এগুলো তদারকি করা। কিন্তু ঠেলাধাক্কায় এসব কাজ যখন আর এগোয় না, তখন আদালতও বাধ্য হয়ে রুল জারি করেন। ব্যবস্থা হিসেবে ইটভাটা ও নির্মাণ প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্তদের জরিমানাও করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে সুরাহা যে হচ্ছে না, সেই প্রমাণ পাওয়া যায় কিছুদিন পরপর বায়ুদূষণে ঢাকার শীর্ষ অবস্থানে উঠে আসায়।

দিল্লিতে বায়ুদূষণের কারণে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যাওয়ায় সেখানে মুখোশ ও অক্সিজেনের ব্যবসা বেড়েছে। নির্দিষ্ট স্থানে বসে টাকার বিনিময়ে অক্সিজেন নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যদি এ দেশেও অক্সিজেনের ব্যবসা নিয়ে হাজির হন একদল ব্যবসায়ী। কিন্তু সেই সওদা করার ক্ষমতা এ দেশের কতজন মানুষের আছে? যে দেশে এখন পেঁয়াজ কিনতে দরিদ্র মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, স্বল্প আয়ের বড় অংশ চলে যাচ্ছে পেয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে, সেখানে অক্সিজেন কিনে নিশ্বাস নেওয়ার কথা ভাবা যায়! সামর্থ্যবানেরা না হয় সেই বন্দোবস্ত করলেন, কিন্তু আমজনতার কী হবে?

বায়ুদূষণ রোধে ব্যবস্থা গ্রহণে বনায়ন করার কথা বলা হয়। বেশি বেশি গাছ লাগাতে হয়। কিন্তু আমরা দেখছি বনায়ন করার বদলে হাজার হাজার হেক্টর বনভূমি ক্রমাগত হারিয়ে যাচ্ছে এ দেশের মানচিত্র থেকে। বনভূমি ও কৃষিজমি কমে যাওয়ার হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দেশ। অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণের দুঃখ আমাদের আরও আছে। শহরে যেসব গাছপালা আছে, সেগুলোও বায়ুদূষণের কারণে হারাচ্ছে টিকে থাকার ক্ষমতা। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকা শহরের রাস্তার পাশের গাছপালার টিকে থাকার ক্ষমতা কমে গেছে। আর এই মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি হারে কমছে।

বায়ুর মান ঠিক রাখতে জলাশয়ের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরের জলাশয়গুলো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দখলে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে থাকার পেছনে অন্যতম কারণ হলো প্রভাবশালীদের এই জলাশয় দখল। এখান থেকেই বোঝা যায় এই পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।

সরকারি হিসাবে যেসব খালের কথা উল্লেখ আছে, সেগুলোর ছিটেফোঁটাও বাস্তবে পাওয়া যায় না। এর ফলে মানুষের দুর্দশা আর ভোগান্তি হয়েছে অন্তহীন। বর্ষাকালে অল্প বৃষ্টিতেই শহরগুলো উপচে সৃষ্টি হয় নোংরা, দুর্গন্ধ পানির বন্যা। বর্ষায় রাস্তায় বের হলে মানুষ সাঁতরায় নোংরা পানিতে আর শুকনা মৌসুমে ধুলার সমুদ্রে। এই হলো আমাদের নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতা। এমন এক জীবনযাপন যেকোনো বিচারেই সামাজিক অস্থিরতা বাড়ায়। সামাজিক অস্থিরতা আর অসহিষ্ণুতার লাগামহীন চিত্রের খবর তো আর কারও অজানা নয়।

২০১৫ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সর্বোচ্চ পরিবেশ পদক ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পেয়েছেন। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ২০১১ সালে বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করা। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে পরিবেশ রক্ষায় সরকারের ভূমিকা আরও জোরদার করা প্রয়োজন। কিছু মানুষের স্বার্থের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের মাধ্যমে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনমান বিষিয়ে তোলা বন্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

খলিলউল্লাহ্ প্রতিচিন্তার সহকারী সম্পাদক
[email protected]