অর্থনীতিতে শৈত্যপ্রবাহ

এবার সারা দেশে হাড়কাঁপানো শীত পড়েছে। অর্থনীতির আবহাওয়াও শৈত্যপ্রবাহে আক্রান্ত। বছর শেষে দখিনা হাওয়ার দেখা নেই; বরং প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী চাপে আক্রান্ত। বেশ কয়েক বছর যাবৎ বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে, বেকারত্ব এবং বৈষম্য বেড়ে চলেছে। এ বছরে রপ্তানি আয় কমেছে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ন্ত, রাজস্ব আহরণ আশানুরূপ নয়, আবার আমদানিও নিম্নমুখী।


চলমান আর্থিক বছরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কর আদায়ে ঘাটতি লক্ষণীয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অক্টোবর ২০১৯ পর্যন্ত এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৫ হাজার ৩১৭.২১ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বলছে, অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৬৫ হাজার ০৯৬.৪৬ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। অক্টোবর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি ৪.৩৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৭৪ শতাংশ।

মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০ শতাংশ করদাতা। প্রতিবেশী দেশে অপেক্ষাকৃত কম হলেও করদাতার পরিমাণ ১৮ শতাংশের মতো। পরিসংখ্যান বলছে, সামর্থ্যবান মানুষের ৬৮ শতাংশই করের আওতায় নেই। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কর-জিডিপি হারও কম। এই হার জাতীয় আয়ের যে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়ে থাকে, তার সঙ্গে সংগতিহীন। কর আদায় ঠিকমতো না হলেও বিপুল পরিমাণ অর্থ আবার বিদেশে পাচার হচ্ছে।

রাজস্ব আদায়ে এমন ধীরগতি থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, অন্যান্য বছরের মতো এবারও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। ফলে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেবে। অন্যদিকে ব্যয় বেড়েই চলছে। অধিকাংশ ব্যয়ই হচ্ছে অনুৎপাদনশীল খাতে। বর্ধিত ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকার ব্যাংকের দ্বারস্থ হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই পূরণ হয়ে গেছে। ব্যাংকগুলো পড়ছে তারল্য–সংকটের দশায়।


চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর মাসে আর্থিক লেনদেন স্থিতি কমে হয়েছে ১৪০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এটি ছিল ২২৪৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে (এফডিআই) তেমন পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। গত অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে এফডিআই ছিল ১৫৬৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে হ্রাস পেয়ে ১১০৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। যদিও চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়কালে কিছুটা বেড়ে ১৬৫২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে।

ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্প সময়মতো শেষ না হওয়া এবং পুনঃপুন ব্যয় বৃদ্ধি অর্থনীতিকে চাপে ফেলেছে। বারবার ঋণ নেওয়ার মাধ্যমে অর্থনীতি ক্রমাগত ঋণের জালে আটকে যাচ্ছে। এই ঋণ এখনই শোধ করা হচ্ছে না। যখনই পরিশোধ শুরু হবে, তখন অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করবে।

চলমান অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ হয়েছে ৭.৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২২.৬৬ শতাংশ বেড়েছে। যদিও মনে করা হচ্ছে টাকার বিপরীতে ডলারের মানের অবমূল্যায়ন এবং ২ শতাংশ প্রণোদনার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথাও বলছে। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকেরা ম্রিয়মাণ অর্থনীতির জাঁতাকলে পিষ্ট পরিবারগুলোর আর্থিক অভাব পূরণ করতে খেয়ে না খেয়ে তাঁদের আয়ের সিংহভাগ দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এরই সঙ্গে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যুক্ত হয়েছে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সংকট। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাসে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ৬০৪,০৬০ দাঁড়িয়েছে। গত বছর একই সময়ে ছিল ৬৮৪,৯৬২।

পোশাক খাতও হুমকির মুখে। গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়কালে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি কমেছে ৭.৭৮ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১৩.০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩.৬৩ শতাংশ কম। বিজিএমইএ বলছে, নভেম্বর পর্যন্ত ৬১টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। ৩১,৬০০ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন।

অন্যদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়া সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সে রকম বাড়েনি। জুলাই-অক্টোবর সময়কালে ৩২.৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে রিজার্ভের পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে আটকে আছে।

বাণিজ্যের ঘাটতি আরও বেড়েছে। আমদানি ব্যয় সামান্য হ্রাস পেলেও রপ্তানির আয়ের ব্যাপক হ্রাসে চলতি জুলাই-অক্টোবর সময়কালে বাণিজ্য স্থিতিতে ৫.৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘাটতি। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৫.৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল। ফলে এ সময়ে সার্বিক লেনদেন স্থিতিতে ঘাটতি ২২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৪৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।


বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস বড় চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে দারিদ্র্য কমার হার কমেছে। ২০০৫ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রতিবছর দারিদ্র্য কমার হার ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়কালে এ হার কমে ১ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যে হারে বাড়ছে বলে দাবি করা হচ্ছে, দারিদ্র্য সে হারে কমছে না।

বেকারত্ব বেড়েই চলেছে। বর্তমানে ৪ কোটি ৮২ লাখের মতো তরুণ বেকার। গত ছয় বছরে শিল্পকারখানার সংখ্যাও বাড়েনি, কমেছে ৬০৮টি। চলমান প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না। আইএলও বলছে, ২৭.৪ শতাংশ তরুণ কোনো ধরনের শিক্ষা, কর্মসংস্থান বা প্রশিক্ষণে নিয়োজিত নেই। এভাবে দেশ জনমিতিক লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মোট কর্মসংস্থানের ৮৫.১ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকের অধিকার ও মজুরি—দুই–ই কম।

দিন দিন অসমতা ও বৈষম্য বাড়ছে। আয়, স্থানিক, লিঙ্গীয়, সম্পদ, সুযোগ ও ক্ষমতার বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। গিনি সহগ ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে ০.৪৮ হয়েছে। পা’মা অনুপাত দিয়ে আয়বৈষম্য পরিমাপ করা হয়। পা’মা বলছে, গত তিন দশকে আয়ের কেন্দ্রীভবন বেড়েছে ৬৯.৩৬ শতাংশ। ১৯৮৫-৮৬ সময়কাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত নিচের দিকের ৪০ শতাংশ জনগণের আয়ের অংশ কমেছে ২৮.৪০ শতাংশ, অন্যদিকে ওপরের দিকের ১০ শতাংশ জনগণের আয়ের অংশ বেড়েছে ২১.৩০ শতাংশ।

বর্তমানে জারি থাকা কৌশলগুলোই অসমতা তৈরি করছে। বিশেষ করে ক্ষমতা, সুযোগ এবং সম্পদের বৈষম্য রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি সম্পদ ও সুযোগের বৈষম্য দূর করতে না পারে, তাহলে সমাজ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। ফলে অপরাধপ্রবণতা ও নৈরাজ্যও বেড়ে যায়। ক্ষমতাহীন মানুষের ওপর অভিঘাত বেশি পড়ে।


কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। ব্যাংক প্রদত্ত মোট ঋণের প্রায় ১২ শতাংশ। গত জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। তিন মাসে (জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু আইএমএফ বলছে, বাস্তবে খেলাপি ঋণ ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা—মোট ঋণের প্রায় ২৬ শতাংশ। আদালতের স্থগিত আদেশ, পুনঃ তফসিল এবং বিশেষ অ্যাকাউন্টের ঋণ হিসাবে নিলে খেলাপি ঋণ হয় সরকারি হিসাবের দ্বিগুণ।

ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এভাবে সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না। বরং সুবিধা দেওয়ার কারণে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ বাড়বে এবং নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারীরাও ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত হবেন।

ব্যাংকিং খাতের মতো পুঁজিবাজারও বেহাল। পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হচ্ছে। অধিকন্তু গোষ্ঠীতন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বাজার মূলধন সৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করছে।


উন্নয়নের ধারণাকে দৃশ্যমান অবকাঠামোগত সংস্কারে সীমাবদ্ধ করার কারণে পরিবেশদূষণের সংকটে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। সম্প্রতি ঢাকার বায়ু বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে পৌঁছেছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর উদ্বেগ। এখন বায়ুদূষণ সম্পর্কিত মৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি সুন্দরবনের পরিবেশগত ক্রিটিক্যাল অঞ্চলে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কারণে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন ঝুঁকিতে রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনার কারণেবাংলাদেশের একমাত্র পার্বত্য দ্বীপ মহেশখালীও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। ফলস্বরূপ, প্রকৃতির সম্প্রীতি নষ্ট হবে এবং পরিবেশের অবক্ষয়ের কারণে অনেকগুলো স্থানীয় ও অন্যান্য বিরল প্রাণ এবং উপকূলীয় প্রবাল বিপন্ন হবে।

গোষ্ঠীতন্ত্রই অর্থনীতিতে শৈত্যপ্রবাহের কারণ। গোষ্ঠীতন্ত্রের কবল থেকে মুক্ত করে সর্বজনের সমাজ ও সর্বজনীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করা না গেলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না। নতুন বছরে আশা করা যায়, সর্বজনের নতুন বাংলাদেশই নিশ্চিত করবে ‘আঁধার পেরিয়ে আসা আগামী সকাল।’

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন