জামিনের পরে মহড়া

মুজিব শতবর্ষে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ রকম একটি সময়ে অনেকগুলো মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে। কিন্তু এ রকম একটি আশাব্যঞ্জক চিত্রকল্পের সঙ্গে যা ভীষণ বেমানান, সেটা হলো সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ক্ষমতাসীন দলের শিথিল মনোভাব। 

একটি দুর্নীতির মামলায় উচ্চ আদালত থেকে স্ত্রীসহ জামিন পেয়ে এলাকায় ফিরেছেন পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল। তিনি একজন সাবেক আইনপ্রণেতা। তাঁকে স্বাগত জানাতে দলীয় নেতা-কর্মীদের তরফে ফিল্মি কায়দার একটি মোটরসাইকেল মহড়া মানুষ দেখেছে। আমরা মনে করি, বিষয়টি দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ ও অসদাচরণের পর্যায়ে পড়ে। তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দ্বারা কোনো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা হওয়ার অভিযোগ নেই। তিনি দলের জন্য কাজ করতে গিয়ে কোনো মিথ্যা মামলার শিকার হননি। 

বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং তার যাবতীয় আইনি কার্যক্রম একান্তভাবে বর্তমান সরকারের দ্বারা সমর্থিত। এই দুদকই অর্পিত সম্পত্তি ও খাসজমিতে ভবন নির্মাণ, পুকুর দখলের অভিযোগে গত ৩০ ডিসেম্বর আউয়ালের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে। একটিতে এমনকি তাঁর স্ত্রী পিরোজপুর জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রীও আসামি হয়েছেন। একটি গণতান্ত্রিক ও আইনের শাসনে অঙ্গীকারবদ্ধ সমাজে এটা একটা বড় মাপের সাংঘাতিক ঘটনা। এ রকম অবস্থার মুখোমুখি হওয়া মানেই রাজনীতিতে কারও মৃত্যুঘণ্টা বাজার সমতুল্য। অথচ তিনি একে একটি বীরোচিত ঘটনায় রূপান্তরিত করেছেন। 

দলে সুশাসন জোরালো থাকলে এমন দৃশ্য ছিল কল্পনার বাইরে। এই ধরনের মামলা হওয়ামাত্রই যা স্বাভাবিক ঘটনা হতো, সেটা হলো তাঁরা স্বামী-স্ত্রী উভয়ে অবিলম্বে নিজ নিজ পদ ছেড়ে দিতেন। কারণ, তাঁরা সমাজে সাধারণ নন, অসাধারণ। অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। স্কুলগামী কোমলমতি শিশু-কিশোরের কাছে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ মন্ত্রিত্বের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। জেলার মহিলা অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেত্রীর আসন একইভাবে মর্যাদাসম্পন্ন। কিন্তু বাস্তবে আমরা এ কী দেখলাম। তাঁরা তো আদালত থেকে নির্দোষ হিসেবে বেকসুর খালাস পাননি। তাহলে তাঁরা কী উদ্‌যাপন করলেন? 

এটা অনুমেয় যে, দুদক জেনে–বুঝে, সুচিন্তিতভাবেই ক্ষমতাসীন দলের জেলা সভাপতির মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে আনা প্রাথমিক অভিযোগ তাই বিশ্বাসযোগ্য। প্রশ্ন হলো, তাহলে কেন তাঁকে অযথা জ্বালানি পুড়িয়ে, রাস্তায় সাধারণ যানবাহন চলাচলের বিঘ্ন ঘটিয়ে মোটর শোভাযাত্রা করে সংবর্ধনা দিতে হলো? আর তিনিই–বা কোন বিচারে সংবর্ধনা নিলেন? তিনি কী আদর্শ তৈরি করলেন? সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কি জামিন পেয়ে এলাকায় এ ধরনের শোডাউন করবেন? 

অবশ্যই, শোভাযাত্রার উদ্যোক্তারা সমাজে একটি বার্তা দিতে চেয়েছেন। জানা যাচ্ছে যে, দুবারের সাবেক সাংসদের সামনে একটি ব্যক্তিগত আশু চ্যালেঞ্জ আছে। সেটা কথিত মতে জেলা সভাপতির পদে আরও এক মেয়াদে টিকে থাকা। সামনে জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে এটাও লক্ষ করি যে, দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত নেতার অভ্যর্থনাকারী হিসেবে তাঁর ভ্রাতৃদ্বয় (মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান) ছাড়াও একাধিক উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সদলবলে অংশ নিয়েছেন। এটা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা অসদাচরণের শামিল। দলের পক্ষ থেকে এসবের জবাবদিহি অবিলম্বে নিশ্চিত করা হোক। 

আমরা আলোচ্য ঘটনাটিকে একটি উদাহরণ হিসেবে দেখছি। আমাদের মূল উদ্বেগ হলো দেশে ক্ষমতাসীন দলীয় সুশাসনে বিরাট ঘাটতি থাকা। এই ঘাটতি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে কার্যকর অন্তরায়। দল যা করতে অপারগ থাকবে, সেই ঘাটতি পুলিশ বা বিচার বিভাগ সেভাবে ঘোচাতে পারবে না। সুতরাং দলীয় শাসন প্রতিষ্ঠাই সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।