ঘূর্ণিঝড়কবলিত কয়রাবাসী

সত্যজিতের গুপী-বাঘা ভূতের রাজার কাছে খাওয়া, পরা ও যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার বর চেয়েছিল। এ দেশের দরিদ্র মানুষ, বিশেষত সিডর-আইলা-বুলবুলে বিধ্বস্ত জনগোষ্ঠী খাওয়া চায়, পরা চায়, কিন্তু গুপী-বাঘার শেষোক্ত অভিলাষ তাদের নেই। তারা চায় খাওয়া-পরার সঙ্গে মাথার ওপর অন্তত এমন একটা চালাবিশিষ্ট পরিকাঠামো থাকুক, যাকে অন্তত বাস্তুবিদ্যার সংজ্ঞায় ঘর বলে চালানো যায়। 

দুর্যোগকবলিতদের জঠর জ্বালা আর লজ্জা নিবারণের সংস্থান করতেই যেখানে দিন পার হয়ে যায়, সেখানে যত্রতত্র ভ্রমণেচ্ছা প্রকাশের সুযোগ কই! আপাতত ‘রোটি-কাপড়া-মকান’ পেলেই তারা খুশি। অথচ বছরের পর বছর বইপত্রে এই কথা পড়ে শিক্ষার্থীরা বড় হচ্ছে, স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার হলো অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা। আমাদের সংবিধানেও এই মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে। 

বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান—এই তিনটি বিষয় অস্বীকারের উপায় নেই। এই তিনের আয়োজনে রাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে, কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে নানা কথা, নানা আশাবাদ শোনানো হয়েছে। বাস্তবতা হলো, রাষ্ট্র এই মৌলিক অধিকার এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। ‘শুধু জীবনটাই আছে, আর সব গেছে ঝড়ে’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে নিদারুণ স্পষ্টতায় সেই সত্য সবার সামনে আরও একবার ধরা দিয়েছে। 

প্রতিবেদনটিতে দেখা যাচ্ছে, ১০ বছর আগে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনার কয়রায় সবকিছু হারিয়ে বাঁধের ওপর ঠাঁই নিয়েছিল পাঁচ শতাধিক পরিবার। ৪ নম্বর কয়রার পুরোনো লঞ্চঘাট এলাকা, ৬ নম্বর কয়রা, দক্ষিণ বেদকাশী, মহেশ্বরীপুরসহ উপজেলাজুড়ে বাঁধের ওপর তাদের সংসার। সংসার মানে কোনোরকমে দিন গুজরান করা। এই ১০ বছরেও জীবনকে আগের অবস্থায় ফেরাতে পারেনি তারা। তার মধ্যেই বুলবুলের আঘাত। উপজেলায় আট শতাধিক ঘর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে এক হাজার আট শর বেশি ঘর। ওই ইউনিয়নের সাড়ে ২৭ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১৫ কিলোমিটার অতি ঝুঁকিপূর্ণ আর ৮ কিলোমিটার বাঁধের অবস্থা এতটাই নাজুক যে তা দিয়ে মোটরসাইকেল পর্যন্ত যেতে পারে না। 

বুলবুলের আঘাতে বাঁধে আশ্রয় নেওয়া মানুষের মাথার ওপরের চালাটুকুও গেছে। এখন আছে বাঁশের চটা আর পলিথিনের ছাউনি। একে সভ্য দুনিয়ায় ‘ঘর’ বলা কঠিন। বাঁধ ভেঙে গোটা উপকূলের জমিতে লোনাপানি ঢুকে গেছে। ফসল হয় না। পুকুরেও লোনাপানি। খাওয়ার পানি নেই। একটা বিশাল জনগোষ্ঠী ‘ভাতে মরছে, পানিতে মরছে’। এলাকায় কাজ নেই বলে এর মধ্যেই বহু মানুষ গ্রাম ছেড়েছেন। 

প্রতিদিন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাটের খবর বের হচ্ছে। অন্যদিকে, ‘অভাবের ঝড়ে ভাঙা মানুষের গাছ আছড়ে পড়ছে এসে পিচের শহরে’। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নন্দিত-নিন্দিত হয়ে ওঠা কবি রোদ্দুর রায় তির্যক প্রশ্ন ছুড়েই যাচ্ছেন, ‘রাষ্ট্র তুমি কী করিতেছ?