বিএনপি ভোটতলায় কবার যায়?

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

ন্যাড়া কবার বেলতলায় যায় সে নিয়ে ভারি ধন্দে পড়েছিলেন সুকুমার রায়ের ছড়ার এক রাজা। রাজা প্রশ্ন শুধান,

লেখা আছে পুঁথির পাতে, ‘নেড়া যায় বেলতলাতে,’
নাহি কোনো সন্দ তাতে—কিন্তু প্রশ্ন ‘কবার যায়?’
এ কথাটা এদ্দিনেও পারে নিকো বুঝতে কেও,
লেখে নিকো পুস্তকেও, দিচ্ছে না কেউ জবাব তায়।
(আবোল তাবোল)

ন্যাড়াকে নিয়ে রাজার এত ভাবনা কেন? নিশ্চয়ই রাজার তাকে নিয়ে কোনো কাজ আছে। এ কথা তাই বলা যায় না যে ন্যাড়া বেলতলায় গেলেই কী, আর না-গেলেই কী। ন্যাড়াকে বেলতলায় আনতে পারলে পুনরায় তার মাথায় বেল ফেলার ব্যবস্থা করা যায়। আর সেই উপায়ও রাজার ভালো করেই জানা।

সেই গল্পই ভালো গল্প যার শেষটা আগাম বলা যায় না। কিন্তু হালফিল বাংলাদেশে নির্বাচনের গল্পের শেষটা মোটামুটি সবারই জানা। তাই শ্রোতা-দর্শকও বেজায় কম। এমনকি গণতন্ত্রের মহামান্য যে ভোটারবৃন্দ, তাঁরাও আজকাল ভোট দিতে বিস্তর কম আসছেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারির পর জাতীয় বা আঞ্চলিক যত নির্বাচন হয়েছে, তাতে সবকিছুই কম। প্রার্থী কম, ভোটও কম, আশাও কম। এত কম যে গণতন্ত্র নিজেই লজ্জা পেয়ে মুখ লুকায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসল-নকল মিলিয়ে ভোট পড়েছিল ৪০ শতাংশ। এর বেশি দেখাতে পারেনি তখনকার নির্বাচন কমিশন। তাতে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৪৬ জনের বিনা চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সেবার ক্ষমতাসীন দলের ২৬৫ জন বিজয়ী বলে ঘোষিত হন। ২০১৮ সালের শেষের নির্বাচনে আরও কম ভোটার হলেও এক দলের সর্বাধিক প্রার্থী-২৯২ জন জয়ী হন।

অবস্থাটা সেই গল্পের মতো। একটা বড় কাজ দুজনে মিলে করার কথা। কিন্তু একজন তুমুল চালাক। সে অন্যজনকে বলছে, ‘তুমি কোনো টেনশন কোরো না, সব টেনশন আমার। তুমি কেবল কাজ করে যাও।’ সরকারও যেন বিএনপিসহ সন্দিহান জনগণকে বলছে, সব টেনশন আমার। তোমরা কেবল দেখে যাও। এ ছাড়া উপায় কী? কৃষ্ণ তো গীতায় বলেই রেখেছেন, ‘যা হয়েছে তা ভালো হয়েছে, যা হচ্ছে তাও ভালো হচ্ছে এবং যা হবে তাও ভালোই হবে।’

বাচ্চারা অনেক সময় অনেক খেলায় অংশ নেয় স্রেফ অংশগ্রহণের আনন্দের জন্য; প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য না। বড়রাও সেটা বলেই তাদের উৎসাহ দেন। বলেন ‘জয়-পরাজয় কিছু নয়, অংশগ্রহণের আনন্দটাই আসল’। বিএনপি ২০১৪ সালে সেই আসল আনন্দে অংশ নেয়নি। অনেকে বলেন, সেবারই তাঁদের সর্বশক্তি নিয়ে নির্বাচনে শামিল হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু তারা তখন সর্বশক্তি নিয়ে ব্যস্ত হয়েছিল নির্বাচন ঠেকাতে। তারপর বিএনপি আর কোনো আসল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়নি। পরের জাতীয় বা আঞ্চলিক, কেন্দ্রীয় বা উপ—সব নির্বাচনেই তারা অংশ নিয়ে সরকারকে আনন্দ দিয়েছে। নির্বাচন কমিশন দেখাতে পেরেছে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিএনপি কোন আনন্দে বা কী দুঃখে গিয়েছিল, তা পরিষ্কার নয়। তবে শিল্পী গেয়ে গেছেন, ‘আমি দুঃখ পেতে ভালোবাসি, তাই তোমার কাছে (নির্বাচনে) ফিরে আসি’।

আইয়ুব বাচ্চুর কথা ও সুরে গাওয়া এই গানটির মধ্যে তাহলে একটা উত্তর পাওয়া গেল। বিএনপি নির্বাচনে যায় নিজে দুঃখ পেয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা দেখাতে, নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা ভঙ্গ করতে। কিন্তু পরিণামে যাত্রাভঙ্গ তো তাদেরই হচ্ছে বারবার। এই রাজনৈতিক শিক্ষা সফর কত দিন ধরে কতবার করে চলবে?

‘লাখোবার যায় যদি সে যাওয়া তার ঠেকায় কিসে?
ভেবে তাই পাই নে দিশে নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?”

আসলেই কি বিএনপির নির্বাচনে না গিয়ে কোনো উপায় নেই? সংসদে তারা নেই, জনসভা করার অনুমতি পায় না। মামলা-গ্রেপ্তার-হয়রানিতে জেরবার দলটি। দলের সভাপতি কারাগারে, দ্বিতীয় প্রধান নেতা আদালতের সাজা মাথায় নিয়ে বিদেশে ফেরার। দলটির অনেক নেতা-কর্মী গুম-হত্যার শিকারও হয়েছেন বলে দেখা যায়। অবস্থাটা এমনই যে ‘ভেবে তাই পাই নে দিশে/ নাই কি কিচ্ছু উপায় তার?’

নির্বাচনের সুযোগে বিএনপির নেতারা প্রচারাভিযানের নাম করে গণসংযোগ করতে পারেন, কর্মীদের চাঙা করার সুযোগ পান, নরম-গরম বক্তৃতা দেন—এটাই বা কম কী? বিনিময়ে নির্বাচন কমিশনও বলতে পারছে, বিরোধী দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন গণতান্ত্রিকভাবেই হচ্ছে। সুষ্ঠু যদি না হয়, ভোটাররা যদি না আসেন, সেই দোষও নিশ্চয়ই বিএনপির। নির্বাচন কমিশনের সচিব অবশ্য ভোটার না আসার জুতসই ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা মিটেছে বলে মানুষ ভোট কম দিচ্ছে। তবে দেশে নির্বাচন হচ্ছে, নির্বাচিতরাই দেশের জাতীয় ও স্থানীয় সরকার চালাচ্ছেন, সরকারের এই দাবিকে বাস্তব প্রমাণ করায় বিএনপির অবদান দলটির অতি বড় শত্রুও অস্বীকার করতে পারবে না। তবে তাদের অনেক ব্যর্থতার মধ্যে একটাই এখন বেশি চোখে লাগে। দিনের ভোটে তারা যেমন–তেমন হলেও রাতের ভোটে একদমই বেচারা।

কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের ময়দানে দাঁড়িয়ে অর্জুনকে বলেছিলেন, ফল আশা না করে তুমি লড়ে যাও। বিএনপিও প্রতিবারই তার কর্মীদের বলেছে, ‘আন্দোলনের অংশ হিসেবে’ তারা নির্বাচনে যাচ্ছে। ফল লাভের আশা না করেই? ফল নাই কে বলল? ফলটা হলো গণতন্ত্রের বিরাট বড় ফলটি আরও পুরু ও ভরাট হওয়া। এবং দিনের শেষে ন্যাড়া যখন বেলতলায় আবার যায়, তখন সেই ফল প্রণয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ফলটি তার মাথাতেই পড়ে।

ব্যাপারটা তাদের জন্য কিংবা দেশের জন্যও দুঃখজনক হলেও অনেকের জন্য কৌতুকের। তাদেরই কেউ হয়তো সুকুমার রায়ের ছড়ার ভাষায় বলে বসবেন,

‘নেড়াকে তো নিত্যি দেখি আপন চোখে পরিষ্কার—
আমাদেরি বেলতলা সে নেড়া সেথা খেলতে আসে
হরে দরে হয়তো মাসে নিদেন পক্ষে পঁচিশ বার।’

পরাজয় নিশ্চিত জেনেও যে লড়ে যায় তাকে বলে ট্র্যাজিক বীর। তাকে বলে সংশপ্তক। কেউ কেউ তাকে নেড়াও বলতে পারেন। বাকিটা সময় বলতে পারবে।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]