ইরান প্রসঙ্গ: আরও প্রশংসা দাবি করতে পারেন ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ নিয়ে উৎসাহী। রয়টার্স ফাইল ছবি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ নিয়ে উৎসাহী। রয়টার্স ফাইল ছবি

প্রথম আলো গত অক্টোবরে যখন কাশেম সোলাইমানিকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমরনায়ক বলেছিল, তখন অনেক পাঠক একমত হতে দ্বিধান্বিত ছিলেন। মাত্র তিন মাস পেরোল। সোলাইমানির মৃত্যু পাঠকের দোলাচল ইতিমধ্যে অনেকখানি কাটিয়ে দিয়েছে। এই মৃত্যু কেবল মধ্যপ্রাচ্যে নয়, ভূকম্পতুল্য উত্তেজনা সঞ্চার করেছে বিশ্বব্যাপী।

গত ৫০ বছরে ইরানের ইতিহাসে দুটি বড় ঘটনা ঘটে। একটি ১৯৭৯ সালের ‘বিপ্লব’। অপরটি অবশ্যই সোলাইমানিকে খুন। গত ৪০ বছরে কোনো না কোনোভাবে পুরো বিশ্বের মুসলমান সমাজে ইরান-বিপ্লবের ছাপ পড়েছে। তাদের দ্বিতীয় ঘটনার বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া কী ঘটবে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে সোলাইমানি ছিলেন ভূরাজনীতিতে ভারসাম্যতুল্য ব্যক্তি। শঙ্কার দিক হলো, ইরানকে মোকাবিলায় তিনি যে যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র টার্গেট নন, সেটা স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমে। তাঁর মৃত্যু ইরানের জন্য এক বিধ্বংসী আঘাত। ভুল করে ইউক্রেনের বিমান ধ্বংস করে সেই আঘাতকে ইতিমধ্যে দেশটি দুর্যোগে পরিণত করে ফেলেছে। সোলাইমানির খুন এখন আর আন্তর্জাতিক মনোযোগে নেই। ইরানের ভেতর রাজনৈতিক বিক্ষোভ প্রচারমাধ্যমে মনোযোগ পাচ্ছে বেশি। ইউক্রেনের বিমান ভূপাতিত করাকে কেন্দ্র করে সেই বিক্ষোভ শুরু হলেও বোঝা যাচ্ছে, ইরানের সমাজে শাসকদের সম্পর্কে অসন্তোষ সংক্রমিত হয়ে আছে। সোলাইমানির জন্য বিশাল জানাজাগুলো যা ধামাচাপা দিতে পারেনি।

ইরান অসাধারণ নজির স্থাপন করেছে

ইউক্রেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নম্বর ৭৫২-এর ১৭৬ যাত্রীকে হত্যা অবশ্যই বর্তমান সময়ের এক হৃদয়বিদারক ট্র্যাজেডি। এটা অসহনীয় ঘটনা। ক্ষমার অযোগ্য ভুল। উপরন্তু ইরানের জন্য চরম আত্মঘাতী। তবে ঘটনার দায় স্বীকার করে ইরান বৈশ্বিকভাবে অসাধারণ নজির স্থাপন করেছে। ৬০ ঘণ্টা বিলম্বে হলেও দেশটি সততার সঙ্গে শর্তহীনভাবে ক্ষমা কামনা করেছে। মৃত ব্যক্তিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিজ দেশের নাগরিক হলেও প্রেসিডেন্ট রুহানি ইতিমধ্যে বিমানের মালিক ইউক্রেনের কাছে জবাবদিহি করেছেন। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এ ঘটনার তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের বিচারের বিষয়েও ইরানের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ইউক্রেন ও কানাডার কাছে অঙ্গীকার করা হয়েছে।

সমকালীন বিশ্বে এ রকম নজির বিরল। ইরানের সমালোচকদের এখন দায়িত্ব বিশ্বজুড়ে নিরপরাধ বেসামরিক মানুষের অন্য সব মৃত্যুর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অপরাধ স্বীকারে বাধ্য করা। ইরানের ‘ভুল’ নিয়ে অনেকেই এই মুহূর্তে উচ্চকিত। তাদের এখন উচিত হবে ইয়েমেন, আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সচেতন হামলার মাধ্যমে যেভাবে মানুষ খুন চলছে, তার জন্য ওই সব স্থানের আক্রমণকারীদের শনাক্ত করা। এমনকি ইরানও আগামী দিনে এ রকম দাবি তোলার অধিকার অর্জন করে নিল তাদের অপরাধ স্বীকার করে।

এ ক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য হতে পারে ১৯৮৮ সালের জুলাইয়ে উপসাগরে তেহরান থেকে দুবাই যাওয়ার পথে ইরানের ‘ফ্লাইট ৬৫৫’কে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মিসাইল দিয়ে ধ্বংস করার ঘটনা। ২৯০ জন যাত্রী তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান সে ঘটনায়। যুক্তরাষ্ট্র আজও ওই ট্র্যাজেডির জন্য ক্ষমা চায়নি। যদিও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের চাপে ১৯৯৬-এ তারা ৬০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। প্রায় একই অভিজ্ঞতা হয় বিশ্বের—যখন ইউক্রেনের আকাশে মালয়েশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান ধ্বংস করে রুশ–সমর্থিত ইউক্রেন গেরিলারা ২০১৪-এর জুলাইয়ে। ২৯৮ জন নিরপরাধ মানুষ মারা গিয়েছিল সেই রুশ মিসাইলে। এসব ঘটনার মধ্যে পার্থক্য হলো, ইরান যখন তার ভুলের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের কথা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে ১৯৮৮ সালের ঘটনায় ক্যাপ্টেন উইলিয়াম রজারকে সামরিক পদকে ভূষিত করা হয়; আর রাশিয়া কখনো তার মিসাইল সরবরাহের দায়ই স্বীকার করেনি।

তবে সোলাইমানির মৃত্যু ও ইউক্রেনের বিমান ধ্বংসের ঘটনায় ইরান নৈতিকভাবে যতই সুবিধাজনক অবস্থায় থাকুক, তার নেতৃত্ব ক্রমে কোণঠাসা অবস্থায় পড়ছে। দেশটিতে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। সোলাইমানিকে হারানোর গোয়েন্দা ব্যর্থতা, কার্যকর কোনো প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ না থাকা, ইরাকিদের মধ্যে ইরানবিরোধী ক্ষোভ সৃষ্টি এবং অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে ইরানি নেতৃত্বের ব্যর্থতা এখন স্পষ্ট। বিমান ধ্বংসের ভুলের জন্য ইউক্রেন ও কানাডার কাছে ক্ষমা চাইলেও আলী খামেনি বা হাসান রুহানিরা নিজ দেশের জনগণের কাছে ভুল বা ব্যর্থতা স্বীকার করতে অভ্যস্ত নন। সোলাইমানির জন্য লাখ লাখ মানুষের যে মাতম, তা শাসকদের বিরুদ্ধে যাওয়ার এখনই শঙ্কা না থাকলেও ইরানের শাসক সম্প্রদায় যে ঘরে-বাইরে তুমুল চাপে আছে, তা খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে।

ইরানের গোয়েন্দা ব্যর্থতা এবং তার ভবিষ্যৎ বিপদ

গত ১০ বছর যুক্তরাষ্ট্রের সেনানায়কদের দুটি প্রশ্ন তাড়া করে ফিরেছে। প্রথমত, সোলাইমানিকে কি হত্যা করা উচিত? দ্বিতীয়ত, হত্যা করা হলে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে কী কী ঘটতে পারে? প্রথম প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের বিস্তারিত উত্তর পেন্টাগনের কাছেও নেই—একধরনের প্রস্তুতি আছে কেবল। এনবিসি ও জেরুজালেম পোস্টসহ অনেক আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম ইতিমধ্যে দাবি করেছে, সোলাইমানিকে হত্যার কাজে সিরিয়া থেকে বেসরকারিভাবে এবং ইসরায়েল থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গোয়েন্দা সহায়তা পায় যুক্তরাষ্ট্র। মৃত্যুর আগে দামেস্ক থেকে বাগদাদে আসছিলেন তিনি একটি বেসরকারি সংস্থার বিমানে চড়ে। এ সময় তাঁর গতিবিধি সম্পর্কে দামেস্ক বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্র যে তথ্য পায়, সেটা তৃতীয় একটি দেশ বাগদাদ বিমানবন্দর থেকে যাচাই করে দেওয়ার পরই সেখানে নিখুঁতভাবে তাঁকে হত্যা করা গিয়েছিল। বাগদাদ ও দামেস্ক—উভয় বিমানবন্দরে ইরানের প্রতিপক্ষরা তথ্য সরবরাহকারী রেখেছিল। এমনকি ওই বিমান সংস্থার কর্মী হিসেবেও ছিলেন একজন তথ্যদাতা। নিউইয়র্ক টাইমস-এর ভাষ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ইসরায়েল প্রশাসনই কেবল আগাম এই অভিযান সম্পর্কে জানত। ইরানের রিপাবলিকান গার্ড ইতিমধ্যে সোলাইমানির গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য ফাঁসের দায়ে অন্তত তিনজনকে আটক করেছে।

নিজ জেনারেলকে রক্ষা করতে না পারা ইরানের গোয়েন্দা অবকাঠামোর বড় ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতায় ভাগ আছে ইরানের মিত্র সিরিয়ারও। আগেও বহুবার প্রমাণিত হয়েছে, ইরানের গোয়েন্দা কাঠামো নিখুঁত নয়। অন্তত ইসরায়েলের সমতুল্য নয়। এ রকম পরিস্থিতি দেশটির জন্য গভীর এক সংকট তৈরি করেছে। কারণ, তিন-চারটি ক্ষমতাধর দেশকে চরম শক্র বানিয়ে রেখেছে তারা এবং তাদের সঙ্গে যুদ্ধও আন্তমহাদেশজুড়ে বিস্তৃত। লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাকজুড়ে নিজেদের উপস্থিতি নিরাপদ রাখা এবং মিত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের রক্ষা করা ইরান ও তার বন্ধুদের জন্য এখন বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। কেবল ইসরায়েল, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্রই নয়, এদের অনেককে খুঁজছে আইএসের ‘ঘুমন্ত’ সদস্যরাও।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান কেউই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ চাইছে না

জেনারেল সোলাইমানিকে হত্যা যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে ইরানের নেতৃত্বের দিকে যুদ্ধের আহ্বানতুল্য হলেও ওয়াশিংটন যে প্রথাগত যুদ্ধ চাইছে না, সেটা স্পষ্ট। সেটা হয়তো সৌদি তেলক্ষেত্রগুলো রক্ষার স্বার্থেই। যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যেকোনো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে ইরানের তরফ থেকে প্রধান লক্ষ্যবস্তু হবে সৌদির তেলসম্পদ। তবে সোলাইমানি হত্যা সৌদি আরব ও ইসরায়েলের স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্য অভিযানই ছিল। ইরানের বর্তমান ‘নিজাম’-এর (শাসনব্যবস্থা) গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক সোলাইমানি। তাঁর পাশাপাশি সেদিন ইয়েমেনে সানার কাছাকাছি কুদ্স ফোর্সের আরেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা আবদুল রেজা শাহালির ওপরও হামলা হয়। ইয়েমেনে সোলাইমানির হয়ে যে গুটিকয়েক ব্যক্তি হুতিদের সঙ্গে ইরানের স্বার্থ দেখতেন, রেজা শাহালি তাঁদের প্রধান। ২০০৮ থেকে তাঁকে তাড়া করছে যুক্তরাষ্ট্র। শাহালি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ১৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে রেখেছিল। ওই হামলার ব্যর্থতা প্রমাণ করছে, সেই ‘নির্ভরযোগ্য তথ্য’ এখনো পায়নি তারা। তবে একই দিনে বাগদাদ ও সানায় কুদ্স ফোর্সের দুই সর্বোচ্চ কর্মকর্তার ওপর আক্রমণ প্রমাণ করে, ইরানকে ছায়াযুদ্ধের সব ফ্রন্টে শক্তভাবে মোকাবিলার নীতি নিয়েছেন ট্রাম্প। বিশেষত কুদ্স ফোর্সকে।

সিরিয়ায় আসাদকে হটাতে ওয়াশিংটনের ব্যর্থতা এবং ইয়েমেনে হুতিদের নির্মূলে সৌদদের হতাশার মূল কারণ কুদ্স ফোর্স। মূলত ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনের সেই যুদ্ধই এখন ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের অঞ্চলে। সোলাইমানিকে হত্যার দিন পেন্টাগন ইরাকে ‘কাত্তাইব হিজবুল্লাহ’র কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহান্দিসকেও হত্যা করে। কাত্তাইব হিজবুল্লাহ ইরাকে ইরানের একটি ছদ্ম হাত।

এভাবে ইরাক, ইয়েমেনজুড়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক ছায়াযুদ্ধের নীতি সৌদি আরব ও ইসরায়েলের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। অর্থনৈতিক অবরোধে ইরানকে দমাতে না পেরে এবং দেশটির ভেতরে হামলা না চালিয়েও ওয়াশিংটন যে ইরান বিষয়ে ভিন্ন এক রণকৌশল নিয়েছে, সোলাইমানি ও শাহালির ওপর সম্মিলিত হামলা তার স্পষ্ট লক্ষণ। তবে ইরানও পূর্ণাঙ্গ ও প্রথাগত যুদ্ধ চাইছে না। ফলে সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন ও লেবাননে দুই তরফে চোরাগোপ্তা হামলার বিস্তারই ঘটবে কেবল। এ রূপ যুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য সিদ্ধান্তসূচক ভূমিকা পালন করে। সেই সূত্রে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি ‘রণাঙ্গন’-এ আন্তসাম্প্রদায়িক বিশ্বাস ও সম্প্রীতি দুর্বল হবে বলে অনুমান করা যায়। একই জনপদে আধা বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে আইএসের পুনর্জন্মের জন্যও এটি একটি সুযোগ। বাগদাদে অনেকের অনুমান, আইএস এবার আবির্ভূত হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো নামে এবং রূপে।

মসুলসহ ইরাক ও সিরিয়ার শহরগুলোতে ২০১৪ থেকে শুরু হওয়া আইএসবিরোধী অভিযানগুলো ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নগরভিত্তিক সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। যার মূল নকশা প্রণয়নকারী ছিলেন সোলাইমানি। আইএসের মোকাবিলায় গত পাঁচ বছরে শিয়া-সুন্নিসহ নানামুখী আদর্শের অনেক শক্তির আন্তমহাদেশীয় যে সম্মিলন ঘটে, সোলাইমানির সঙ্গে সঙ্গে সেটাও এখন কবরস্থ হয়ে গেছে বলা যায়।

ইউক্রেনের উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার পর ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়েছে। রয়টার্স ফাইল ছবি
ইউক্রেনের উড়োজাহাজ ভূপাতিত করার পর ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়েছে। রয়টার্স ফাইল ছবি

এই সংঘাতে সৌদি আরবের ভূমিকাও মুসলমান সমাজের শিয়া-সুন্নি দূরত্বে নতুন জ্বালানি জোগাতে শুরু করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে আফ্রিকার মাগরেব অঞ্চল এবং এশিয়ার পাকিস্তান-আফগানিস্তান অঞ্চলে ইতিমধ্যে বিপজ্জনকভাবে সেই উত্তেজনার বিস্তার ঘটছে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ‘যুদ্ধ বন্ধ’-এর জন্য সোলাইমানিকে হত্যার দাবি করলেও যুদ্ধাবস্থা আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে কেবল। আসন্ন সেই যুদ্ধের রূপ হতে পারে ভিন্ন, অনেক অদৃশ্য এবং কিছুটা ধর্মীয় চরিত্রের। এমনকি তা দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত ছড়াতে পারে। ওয়াশিংটনের চাপে লেবাননের হিজবুল্লাহকে প্যারাগুয়ে ও আর্জেন্টিনার ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করা তারই ক্ষুদ্র আলামত। এই অঞ্চল হিজবুল্লাহর অর্থ সংগ্রহের এক বড় ঐতিহাসিক উত্স হিসেবে বিবেচিত হয়। সাইবার হামলায়ও ইরান-সমর্থকদের ভালো দক্ষতার নজির মিলছে সোলাইমানির মৃত্যুর পর। এসবের পাল্টা হিসেবে ইরানের বিরুদ্ধে ‘মুজাহিদিন-ই খাল্ক’ এবং ‘জুনদাল্লাহ’র মতো সংগঠনগুলো ইসরায়েলের মদদ পেতে পারে। এসব সংগঠন প্রায়ই পাকিস্তান ও ইরাক সীমান্ত দিয়ে ইরানের ভেতরে ঢুকে হামলা চালাচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় আন্তসাম্প্রদায়িক রক্তক্ষয়ের এই পদধ্বনিতে শঙ্কিত সুদূর পাকিস্তান-আফগানিস্তানও। এই বিবাদে বড় বিব্রতকর অবস্থায় আছে পাকিস্তান। সৌদি আরব ও আরব আমিরাত তার দরকারি মিত্র। আবার বিশাল এক শিয়া জনগোষ্ঠীও আছে সে দেশে। আছে ইরান সীমান্তে বালুচ গেরিলাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্পরতাও। ফলে ইরান-সৌদির দ্বন্দ্বে খুব কষ্ট করে নিরপেক্ষতার অভিনয় করতে হয় তাকে। সৌদি যদিও পাকিস্তানের সৈনিকদের ইয়েমেন যুদ্ধে জড়াতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু ইসলামাবাদ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যতটা পারা যায় দূরে থেকেছে। তবে ওয়াশিংটন ও রিয়াদ ইরানবিরোধী তত্পরতায় বারবারই পাকিস্তানকে চাইতে থাকবে। এই চাওয়ার প্রতিক্রিয়া হবে আফগানিস্তানেও। যেখানে স্বার্থ রয়েছে ভারত-রাশিয়া-চীনেরও।

আফগানিস্তানের শিয়া হাজারাদের সঙ্গে ইরানের বন্ধুত্ব সরাসরি। দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র এই হাজারারা। এ সম্পর্কের অবনতি আফগানিস্তান থেকে দখলদারদের চলে যাওয়া আপাতত অসম্ভব করে তুলবে। পুরোনো এই যুদ্ধক্ষেত্রকে ব্যবহার করে ইরানবিরোধী তত্পরতা চালানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অপর অসুবিধার দিক—তালেবানদের সঙ্গে ইরানের কৌশলগত সম্পর্ক এখন ভালো যাচ্ছে। হাজারা ও তালেবানদের এ রকম ভূমিকার মোকাবিলায় সোলাইমানির মৃত্যুর পর সেখানে আইএসের আগমন ঘটার পথ সুগম হতে পারে। পরিণতিতে সংখ্যালঘু হাজারারা রক্তাক্ত আত্মঘাতী হামলার লক্ষ্য হবে। সোলাইমানির মৃত্যু তাদেরও নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে। আইএসের সক্রিয়তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার আরও কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ তৈরি করা কঠিন। পাশাপাশি সোলাইমানির মৃত্যু আইএসের জন্য সর্বোত্তম উপহারস্বরূপ হয়েছে।

ট্রাম্প যে কারণে আরও প্রশংসা পেতে পারতেন

জেনারেল সোলাইমানির বিদায়ে ইরানের ‘নিজাম’ কেবল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের যুদ্ধক্ষেত্রে নয়, অভ্যন্তরীণভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত। রাজনৈতিক বিক্ষোভ দমনে কুদ্স ফোর্স এত দিন প্রশ্নহীন আনুগত্যে আলী খামেনির ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেছে। রিপাবলিকান গার্ডের অন্যান্য ইউনিট সেভাবেই ‘কাজ’টি করে যাবে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিশেষ করে যখন দেশটির মানুষের বাজার-সদাই খরচ ওয়াশিংটনের নতুন অবরোধে আরও বেড়ে চলেছে। বাড়তি দাম দিয়েও দুষ্প্রাপ্য অনেক পণ্য। ট্রাম্পের ১০ জানুয়ারির সর্বশেষ অবরোধ ইরানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অবশিষ্ট পথগুলোও বন্ধ করে দিতে পারে। ইতিমধ্যে তেলের উত্পাদন ও বিক্রি—দুটিই পড়ে গেছে। জিডিপি কমছে। ফলে বিনিয়োগ কমছে এবং বেকার বাড়ছে। রিয়াল ও ডলারের বেসরকারি বিনিময় হার সরকারি হারের প্রায় দ্বিগুণ। সরকারের জন্য পরবর্তী বিকল্প হবে করহার বাড়ানো এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকা কিছু প্রতিষ্ঠান বিক্রি করা।

কিন্তু বিশ্বের ১০ শতাংশ জ্বালানির মজুত থাকার পরও অর্থনীতির দৈন্যদশা দীর্ঘায়িত হলে ইরানের জনগণ নিশ্চিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বদলে হাতের কাছে থাকা সরকারকেই দায়ী করবে। সিআইএ, মোশাদ ও জিআইপি এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে তত্পর থাকবে। তারা জানে, চলতি অর্থনীতি নিয়ে ইরান তার ছায়াযুদ্ধের বিশাল সাম্রাজ্যের ক্ষুধা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। ট্রাম্পের দিক থেকে তাই সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ‘সময়োচিত’। যদিও ইরানের জনগণের জন্য তা নির্মম, কিন্তু ট্রাম্প ইরান প্রশ্নে নিজেকে দূরদর্শী প্রতিপক্ষ প্রমাণ করেছেন ইতিমধ্যে। দুটি ড্রোন হামলায় দেশটিকে বহু ফ্রন্টে বিপদে ফেলেছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপ স্টেট’ হয়তো এ রকম একজন সিইওকে আরও চার বছর ধরে রাখতে চাইবে। ইরাকে ক্ষয়ক্ষতিহীন হাস্যকর এক মিসাইল ‘হামলা’র মাধ্যমে তেহরান ট্রাম্পের বিজয়রথে বাড়তি গতি দিয়েছে মাত্র।

তবে ৩ জানুয়ারি সোলাইমানিকে খুনের ৭০ দিন আগে কাছাকাছি জনপদে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে আইএসের প্রধান বাগদাদির নিহত হওয়াই গত এক বছরে ট্রাম্পের দিক থেকে সবচেয়ে বড় বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত। অজ্ঞাত কারণে মিডিয়া এই দুই হামলার যোগসূত্র খুঁজতে আগ্রহ দেখায়নি। সেটা হলে ট্রাম্প আরও কিছু প্রশংসা পেতে পারতেন।

ট্রাম্পের এই নতুন কৌশলের ভিত্তি তৈরি করেছে দেশটির জ্বালানি পরিস্থিতি। গত কয়েক মাস থেকে যুক্তরাষ্ট্র আমদানির চেয়ে বেশি রপ্তানি করতে পারছে জ্বালানি। সাত দশক পর এ রকম ঘটনা ঘটল। দেশটির এই সফলতা আগামী কয়েক দশক অব্যাহত থাকতে পারে।

গত এক দশকে তেল ও গ্যাস উত্তোলনে যুক্তরাষ্ট্র অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটিয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান অনেক সহজ হয়েছে তার জন্য। সোলাইমানিকে হত্যা করে ওয়াশিংটন সেই নতুন পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। ৩ জানুয়ারির ড্রোন হামলার পেছনে ট্রাম্পের জন্য বড় ভরসার জায়গা ছিল সেটা। বিশ্বের সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ বার্তা রয়েছে এই পরিস্থিতিতে। এমনকি সৌদির জন্যও। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সৌদির খনিজ সম্পদের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যেতে পারে শিগগিরই।

আলতাফ পারভেজ, গবেষক