পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান

দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা অধিকতর দায়িত্বশীল ও উচ্চ নৈতিকতাসম্পন্ন হবেন, এটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা। এবং ব্যতিক্রম বাদে বাংলাদেশের উচ্চ বিদ্যাপীঠে এটিই একসময়ের সাধারণ বাস্তবতা ছিল। কিন্তু অতীতের সুদিন, ঐতিহ্য নেতিবাচকভাবে ভীষণ বদলেছে। এই বদলে যাওয়ার বিষয়টির দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যথার্থই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

রাষ্ট্রপতি স্মরণ করিয়েছেন যে আপনারা লোভনীয় চাকরি না নিয়ে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে
দেশে চরম বেকারত্ব বিরাজমান। তাই চাকরি বাছাইয়ে কোনটা লোভনীয়, কোনটি আদর্শিক, সেই বাছবিচার আর অতীতের মতো নেই। শিক্ষকদের জৌলুশহীন, নির্মোহ জীবন এখন বিরল। বরং রাষ্ট্রপতি যখন বলেন, ‘কিছু শিক্ষকের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি একটা ঢাল। তাঁরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহজুড়ে সন্ধ্যাকালীন ক্লাস নিতে আগ্রহী অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের নির্ধারিত ক্লাস নিতে অনাগ্রহী।’ তবে রাষ্ট্রপতি
হয়তো এটাও জানেন যে কেউ কেউ শুধু অন্যত্র পাঠদান নয়, শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, এমন সব ‘লোভনীয়’ বা সংকীর্ণ অর্থে দলীয় কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট থাকছেন। এর সবটাই পাঠদানের প্রতি শিক্ষকদের গুণগত মান ক্ষুণ্ন করছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। আচার্য হিসেবে রাষ্ট্রপতি সম্ভবত এই প্রথম প্রশ্ন তুললেন, উপাচার্যরা দুর্নীতি করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কী হবে। বিলম্বে হলেও তিনি একটি কঠিন সত্য উচ্চারণ করেছেন, তাঁর এই সত্যকথন ধন্যবাদার্হ। আমরা লক্ষ করি যে ঐতিহ্যবাহী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু তার প্রতিকার নেই বললেই চলে। তবে অনিয়ম গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে সংক্রমিত করছে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খরচের সিংহভাগের জোগানদাতা জনগণ। সে কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরোনো মেধাবীদের কাছে দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের চাওয়া-পাওয়ার একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সেখানে শিক্ষার মান উন্নয়ন, পাঠদানের প্রতি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষকেরা
অন্যদের থেকে যত দূর সম্ভব স্বকীয়তা ফুটিয়ে তুলবেন। তাঁরা অন্যদের জন্য আদর্শস্থানীয় হবেন। কিন্তু বাস্তবতা অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট হতাশাব্যঞ্জক। এখন দুঃখজনকভাবে নানা কাহিনি বেরিয়ে এসেছে। যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগলাভের পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে ঝুঁকে পড়া। এমনকি সবেতন দীর্ঘ ছুটিতে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে অভিবাসী হিসেবে পাকাপাকিভাবে বিদেশেই থেকে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

এটা অত্যন্ত গর্হিত যে শিক্ষকেরা তথ্য গোপন করছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যসহ যাঁদের এসব দেখার এখতিয়ার, তাঁরা উদাসীন থাকছেন। এর ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষক পাঠদানে আগ্রহ হারাচ্ছেন। তদারকি না থাকার কারণেও শিক্ষকদের একটি অংশ দ্রুত বিপথগামী হচ্ছেন। তাঁরা এনজিও, ব্যবসা, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন ধরনের চাকরি করছেন। এর ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ নেই। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, তাদের পরিচালনা পর্ষদের তা নিয়ে কোনো বিকার নেই। এমনকি কোনো আলাপ-আলোচনা বা অনুশোচনা আছে বলেও প্রতীয়মান হয় না। অবশ্য বিবেকবান শিক্ষকেরা নিশ্চয় এ নিয়ে ব্যথিত, বিচলিত ও উদ্বিগ্ন।

শিক্ষকদের ছুটি ও পাঠদান নিয়ে যা ঘটছে, তা মামুলি অনিয়ম নয়, এসব প্রতারণা ও দুর্নীতি, যা ফৌজদারি আইনে দণ্ডনীয়। আমরা আশা করব, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, উপাচার্যরা ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এসব রোধে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেবে।