ইরান-যুক্তরাষ্ট্র: উপসাগরীয় সংঘাতে কী করছে ইউরোপ

রয়টার্স ফাইল ছবি
রয়টার্স ফাইল ছবি

পারস্য উপসাগরে চলমান ইরান-মার্কিন সংঘাতে ইউরোপের নির্লিপ্তভাবে চেয়ে থাকার বিষয়টি নিয়ে ইউরোপীয় জনগণ ও গণমাধ্যমের কাছে ক্রমেই রহস্যময় ঠেকছে। ৩ জানুয়ারি ভোরে বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে মার্কিন হামলায় ইরানের কুদস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল কাশেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোট কোনো যৌথ বক্তব্য দেয়নি। তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টিও ইউরোপীয় রাজনীতির রীতি বটে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইরান-মার্কিন বিরোধের সমাধানের জন্য বিকল্প কিছু করার আশায়, ঘটনার সাত দিন পর ১০ জানুয়ারি ব্রাসেলসে বৈঠক করছেন। বৈঠক মূলত পারস্য উপসাগরে চলমান বিরোধের বিষয়ে সদ্য নির্বাচিত ইইউ কমিশনার কমিশনের সভানেত্রী উরসুলা ভন ডের লেইন কূটনীতিক আলোচনা ও পুনরায় পারমাণবিক চুক্তির পুনরুজ্জীবনের বিষয়ে কথা বলছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক নীতিবিষয়ক প্রধান জোসেফ ব্যারেল বলেছেন, এই চুক্তি এখন আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তবে খোদ ব্রাসেলসে কূটনীতিকেরা স্বীকার করছেন, এই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় পুরোনো বন্ধুদের প্রতি খুব কম আস্থা রাখে। যদিও ঘটনার পরপরই জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

পৃথিবীর যে অঞ্চলে মার্কিন রাজনীতি বা অর্থনৈতিক স্বার্থ খাটে না, তা ইউরোপ। ২০১৭ সালে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর ইউরোপ থেকে তৈরি গাড়ি, ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম আমদানির ওপর শুল্ক চাপানো, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি বাতিল, জেরুজালেমে মার্কিনদের দূতাবাস স্থানান্তর এবং জলবায়ু ও পরিবেশসংক্রান্ত প্যারিস চুক্তি থেকে বের হয়ে যাওয়া নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইউরোপীয় পুরোনো মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলেছে কয়েক বছর থেকেই। তবে তা এখন আরও প্রকট হয়েছে।

ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য রয়েছে এমন ইউরোপীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্তকরণ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য বন্ধ করার হুমকি দিয়েছে ওয়াশিংটন। সর্বশেষ ডিসেম্বরে হুমকি এসেছে রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির মেগা প্রকল্প উত্তর ইউরোপীয় গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পে সংযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করার নির্দেশে। ১ হাজার ২২৪ কিলোমিটার লম্বা উত্তর ইউরোপীয় গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পটি জার্মানিতে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। পাইপলাইনটি রাশিয়া থেকে পূর্ব সাগরের ফিনল্যান্ড, সুইডেন ও ডেনমার্কের সমুদ্রসীমা দিয়ে জার্মানিতে এসে শেষ হয়েছে। এ ধরনের মার্কিন হুমকিতে সম্প্রতি জার্মান–মার্কিন সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে।

২০১৮ সালের ৪ মে ইরানের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক কর্মসূচি বা জেসিপিওএ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আবারও ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে এবং অন্যদেরও এ অবরোধে শামিল হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া চুক্তিবদ্ধ সবাই এই পারমাণবিক চুক্তিটি রাখার পক্ষে রয়েছে। ২০০৩ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরাকের কাছে রাসায়নিক অস্ত্র আছে—এই মিথ্যা অভিযোগ তুলে দেশটিতে অনৈতিক ও অযাচিতভাবে বর্বরোচিত হামলা করেছিলেন। এবারও অনেকটা তা–ই, কোনো তথ্যপ্রমাণ ও তদন্ত প্রতিবেদন ছাড়াই ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচি চুক্তি ভাঙার দায়ে দোষারোপ করা হয়েছে। আর সর্বশেষ ইরানের জনপ্রিয় সেনাপতি জেনারেল কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রথম থেকেই এককাট্টা হয়ে বলছে, ২০১৫ সালে করা পারমাণবিক চুক্তি আমাদের নিরাপত্তার জন্যই। তাই যুদ্ধ আমাদের কাম্য নয়।

তবে ইইউ সদস্যদেশগুলো কতটা শক্তি সঞ্চয় করে ইরানের প্রতি মার্কিন আস্ফালনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। বিগত কয়েক দশকের
মধ্যে ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই মুহূর্তে সব থেকে বেশি নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ইউরোপের কিছু দেশে ডানপন্থীদের উত্থান, পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ ও রাশিয়ার সঙ্গে টানাপোড়েন ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এই সংকটের মুখে ফেলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিগত প্রায় ৭০ বছর মার্কিনদের সঙ্গে টানা বন্ধুত্ব আর মৈত্রীর সম্পর্কে হঠাৎ করেই টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ক্ষয়িষ্ণু জোট ও সময়ের বিবর্তনে তা ভেঙে পড়বে বলে অভিহিত করেছিলেন। যুক্তরাজ্যের মতো ভবিষ্যতে আরও দেশ জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন। এ ছাড়া বেশ কিছুদিন থেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অভিযোগ করে আসছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর জন্য গঠিত প্রতিরক্ষা তহবিলের (ইডিএফ) বা প্রস্তাবিত ইউরোপীয় সেনাবাহিনীর জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করছেন। অথচ ইউরোপীয় দেশগুলো, বিশেষ করে জার্মানি ন্যাটো জোটের তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ প্রদান না করে ইইউ প্রতিরক্ষা তহবিলে বেশি ব্যয় করছে। বিষয়গুলো সত্য না হলেও ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই অধিকাংশ সাবেক ইউরোপীয় মিত্রদের বিরুদ্ধে তিনি এখনো বিষোদ্গার করে চলেছেন।

বেশ কিছুদিন থেকেই ইউরোপের দুই বড় শক্তি জার্মান ও ফ্রান্স যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে ইউরোপের অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা নির্ভরশীলতা কমিয়ে ইউরোপকে নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে নেওয়ার বিষয়ে কথা বলছে। নিজ স্বার্থে ট্রাম্পের একলা চলা নীতি বা নতুন ইউরোপ-ভাবনা আমেরিকাকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যাবে, তা দেখতে আরও সময় লাগবে বটে, তবে তিনি যে এখন আর ইউরোপে ভালো মিত্র নন, এখন তা পরিষ্কার।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]