ধর্ষকের শাস্তি নিয়ে বিতর্ক

রেনহার্ড সিনাগাকে বলা হচ্ছে ব্রিটেনের সবচেয়ে ভয়ংকর ধর্ষক। তাঁর বিরুদ্ধে ৪৮ জন তরুণকে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, পুলিশ বলেছে, এ সংখ্যা ১০০ জনের বেশি হতে পারে। তাঁকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বিচারকেরা বলেছেন, তাঁকে অন্তত ৩০ বছর জেলে থাকতেই হবে। কারণ, মুক্ত সিনাগা যেকোনো মানুষের জন্য চরম বিপজ্জনক।

সিনাগার বয়স ৩৬ বছর। ইন্দোনেশিয়ার ধনবান একটি পরিবারের সন্তান। ব্রিটেনের ম্যানচেস্টারে আসেন ২০০৭ সালে। সেখানে তিনটি ডিগ্রি করার পর তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি করছিলেন লিডস ইউনিভার্সিটিতে। থাকতেন ম্যানচেস্টারের নাইট ক্লাব অঞ্চলে একটি ভাড়া করা ফ্ল্যাটে। নাইট ক্লাব থেকে মাতাল অবস্থায় বের হওয়া তরুণদের সাহায্য করার নামে তাঁর ফ্ল্যাটে নিয়ে এক গন্ধহীন, রংহীন মাদক সেবন করিয়ে সমকামী সিনাগা তাঁদের ধর্ষণ করতেন। জেগে উঠে তাঁদের অধিকাংশ কিছু স্মরণ করতে পারতেন না, পারলেও তা লজ্জায় পুরোপুরি চেপে যেতেন। ২০১৭ সালে তাঁর একজন ভিকটিম হঠাৎ জেগে উঠে তাঁকে মারধর শুরু করলে সিনাগার নির্মম ও পাশবিক অপরাধের ঘটনাগুলো বের হয়ে আসে।

সিনাগার বিচারকার্য চলাকালে বিস্মিত, বিপর্যস্ত তরুণদের অনেকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের প্রায় সবাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। মনোবিশারদেরা বলেছেন, তাঁদের কারও কারও মধ্যে এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা গেছে। তাঁদের বক্তব্য, ধর্ষণকালে যেভাবে একজন মানুষকে অক্ষম, অসহায় ও পর্যুদস্ত করে তোলা হয়, তার ক্ষত সারা জীবনেও মোচন হওয়ার মতো নয়।

সিনাগার ভিকটিমরা শিক্ষিত, অনেকেই স্বাবলম্বী, পরিচয় গোপন রাখতে সক্ষম এবং উন্নত সমাজ-সংস্কৃতিতে থাকা মানুষ। তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশের মতো দেশে ধর্ষণের শিকার নারীদের অসহায়ত্ব ও প্রতিকূলতার কোনো তুলনাই হয় না। ধর্ষণ তাদের জীবনে কী ভয়ংকর ও ভয়াবহ, অমোচনীয় পরিণতি ডেকে আনে, তা সিনাগার ভিকটিমদের মানসিক অবস্থা শুনে আমরা সামান্যই উপলব্ধি করতে পারব।

বাংলাদেশে এই অপরাধের শিকার নারীরা শুধু ধর্ষণেই রেহাই পায় না; প্রচারমাধ্যমের অসতর্কতা তাদের নতুন সমস্যায় ফেলে, বিচারহীনতার কষ্ট তাঁকে প্রতিদিন সহ্য করতে হয়, অনন্তকাল ধরে শিকার হতে হয় বিভিন্নভাবে সামাজিক নিগ্রহের। ধর্ষণের বা যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা তাই আমরা শুনি। যারা বেঁচে থাকে, তাদের স্বাভাবিক সত্তারও মৃত্যু ঘটে। ধর্ষিতার পরিবার আর স্বজনদের ভেতর থাকে একই ধরনের অনুভূতি।

২.

ধর্ষণ পৈশাচিক ধরনের অপরাধ। এমন অপরাধ সমাজে একের পর এক ঘটতে থাকলে আমরা অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলি। শিশু, প্রতিবন্ধী, ছাত্রী, কর্মজীবী গৃহবধূসহ নির্বিচার ধর্ষণের ঘটনায় আমাদের অনেকের তা–ই হয়েছে। ফেসবুক খুললে দেখা যাবে ধর্ষণের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার নানা ধরনের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ করছেন বিশদভাবে।

এসব দাবি অগ্রহণযোগ্য হতে পারে, কিন্তু তা অস্বাভাবিক বিষয় নয়। অস্বাভাবিক হচ্ছে এমন দাবি যখন আসে রাষ্ট্রের আইনসভার সদস্যদের কাছে থেকে। এটা উন্মাদনার পর্যায়ে চলে যায় যখন তাঁরা বিচার করে মৃত্যুদণ্ড নয়, বিচার ছাড়াই ক্রসফায়ারে মেরে ফেলতে বলেন সন্দেহভাজন ধর্ষককে।

আমাদের আইনপ্রণেতারা যেভাবেই নির্বাচিত হন না কেন, তাঁদের সংবিধান রক্ষার শপথ গ্রহণ করতে হয়। সংবিধানে বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদ (যেমন ২৭,৩১, ৩৫) অনুসারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম বা ক্রসফায়ার সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যাঁরা ক্রসফায়ারের দাবি তুলছেন, তাঁরা সংবিধান লঙ্ঘনকে উৎসাহিত করে সংবিধানেরই ৭ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহমূলক অপরাধ করছেন বলা যায়।

ক্রসফায়ারের দাবিটি ইতিমধ্যে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। এই দাবির বিন্দুমাত্র ন্যায্যতা নেই। তবে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত কি না, এ নিয়ে সমাজে মতভেদ রয়েছে। সমাজে ধর্ষণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে এ বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।

যাঁরা ধর্ষকের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে, তাঁরা মূলত ডেটারেন্ট থিওরি অব পানিশমেন্টের কথা বলেন। এই মতবাদ অনুসারে সবচেয়ে কড়া শাস্তি দেওয়া হলে ভয়ে কেউ আর সেই অপরাধ করেন না। বাংলাদেশে অ্যাসিড নিক্ষেপ অপরাধ দ্রুত কমে গিয়েছিল এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার পর এবং বেশ কয়েকটি মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর। তবে আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে এই আইনটি প্রয়োগের সময় অ্যাসিড কেনাবেচায় নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত একটি আইনও খুব কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। কাজেই শুধু মৃত্যুদণ্ডের কারণে অ্যাসিড নিক্ষেপের অপরাধ কমে গেছে, এটা ঢালাওভাবে বলা যাবে না। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় খুনের অপরাধে। শুধু মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অপরাধ কমাতে পারলে খুনখারাবি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার কথা দেশে। কিন্তু তা হয়নি।

মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে আরও কিছু যুক্তি আছে। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হন পরিচিত ব্যক্তি। ফলে এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করলে ধরা পড়ার ভয়ে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে হত্যা করার প্রবণতা বাড়বে। মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ প্রমাণ অনেক বেশি সুশক্ত থাকতে হয় বলে এর বিচার আরও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়তে পারে।

আমার মতে, ধর্ষণের প্রকোপ কমানোর সবচেয়ে বড় উপায় বরং এর শাস্তি নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে ধর্ষণ অপরাধের শাস্তি হয় খুবই কম। সুবর্ণচরের গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনার মতো কিছু ক্ষেত্রে ধর্ষক ক্ষমতাসীন দলের কেউ হলে জামিন পেয়ে বিচার বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেন। অনেক ক্ষেত্রে সফলও হন।

ধর্ষণের শাস্তি প্রমাণে আরও কিছু সমস্যা রয়েছে। সাক্ষ্য আইনের ত্রুটিবিচ্যুতি, ফরেনসিক প্রমাণ সংগ্রহে দুর্বলতা, বাদীর আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতা দীর্ঘদিনের সমস্যা। সরকার চাইলে এসব সমস্যা দূর করা সম্ভব। সম্ভব ধর্ষণের দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ আদালত গঠন।

৩.

ধর্ষণের বিচারের পাশাপাশি এর প্রিভেনশন বা নিবারণের কথাও ভাবা উচিত। যোগাযোগ প্রযুক্তি, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের অবাধ বিস্তার এবং নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে এ দেশে পর্নোগ্রাফির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। এর পাশাপাশি মাদকের সর্বনাশা প্রকোপ এ দেশে ধর্ষণবান্ধব এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।

অপরাধের ব্রিডিং গ্রাউন্ড বা প্রজননক্ষেত্র অবাধ রেখে শুধু অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে দেশে কোনো অপরাধ কমতে পারে না। ধর্ষণের ক্ষেত্রে এ কথা পুরোপুরি প্রযোজ্য। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, সংসদে বা অন্য কোথাও আলোচনা উঠলে আমাদের অনেকেই এসব জরুরি বিষয় এড়িয়ে যান। ক্রসফায়ারের চটকদার কথাবার্তা বলতে তাঁদের যত আগ্রহ, সমস্যা তলিয়ে দেখার মনোযোগ তাঁদের ততটা থাকে না।

৪.

ধর্ষণের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে এখনই। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের জরিপে দেখা গেছে, ধর্ষণের প্রকোপ শিক্ষা ও সম্পদে অনগ্রসর দেশে তুলনামূলক বেশি। কিন্তু এসব দেশে তারপরও ধর্ষণের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা খণ্ডিত চিত্র মাত্র। লোকলজ্জা, নিরাপত্তাহীনতা ও বিচারের দৈন্য দেখে এসব দেশে বহু ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করা হয় না। তারপরও আমরা পত্রিকায় যতটুকু দেখি তা শিউরে ওঠার মতো। শিশু ধর্ষণের যেসব খবর পড়ি, তা যেকোনো মানুষকে স্তব্ধ করার মতো।

ধর্ষণের বিচার তাই নিশ্চিত করতে হবে। মৃত্যুদণ্ডের কাগুজে আইনের চেয়ে নিশ্চিত বিচারের পরিবেশ সৃষ্টি করা অনেক বেশি প্রয়োজন এখন। জনগণের অর্থে পরিচালিত পুলিশ, সরকারি উকিল আর আদালত সে কাজটি কীভাবে সর্বোত্তমভাবে করতে পারবে, সেটা খুঁজে বের করা কঠিন কিছু নয়।

এ জন্য সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক