আশা করি, তাঁরা সভ্যতা-ভব্যতার পরিচয় দেবেন: ড. তোফায়েল আহমেদ

ড. তোফায়েল আহমেদ। স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ
ড. তোফায়েল আহমেদ। স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ
>

ড. তোফায়েল আহমেদ। স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে কুমিল্লা ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এর আগে শিক্ষকতা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকায় দুই সিটি করপোরেশন সামনে রেখে প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন নির্বাচনী ব্যবস্থা ও স্থানীয় শাসনপদ্ধতি ও জনপ্রতিনিধিত্ব নিয়ে।সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান।

প্রথম আলো: নির্বাচনী ব্যবস্থাটি তো ভেঙে পড়েছে। টেনে তোলার উপায় কী?

তোফায়েল আহমেদ: নির্বাচনী ব্যবস্থা পুরোটা ভেঙে পড়েছে, এ কথা বলা যাবে না। নির্বাচনের প্রতি জনগণের আগ্রহ আছে, রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমরা কীভাবে বলব নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আমাদের বড় দুর্বলতা হলো ব্যবস্থাপনার। নির্বাচনে অনিয়ম–বিচ্যুতি ঘটলে আইনেই তার প্রতিকার আছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে মাঠ গরম করলেও আদালতে যায় না, আইনের আশ্রয় নেয় না, এটি বড় দুর্বলতা। নির্বাচনে অনিয়ম হলে তার প্রমাণাদিও থাকবে। আজকাল প্রমাণাদি সংরক্ষণ করা কঠিন কাজ নয়। একটি মোবাইল ফোনেও অনেক সাক্ষ্যপ্রমাণ রাখা যায়। সেসব প্রমাণ আদালতে হাজির করলে প্রতিকার পাওয়া অসম্ভব নয়। আমাদের সমস্যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই তথ্যপ্রমাণ রাখা হয় না। আগে নির্বাচন কমিশনই নিজস্ব পর্যবেক্ষক নিয়োগ করত। তাদের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হতো। পর্যবেক্ষকদের রিপোর্ট আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হতো। এখন তো নির্বাচন কমিশন কোনো পর্যবেক্ষণ নিয়োগ করে না। ফলে নির্বাচনের প্রতি মানুষের আগ্রহও কমে গেছে।

প্রথম আলো: কেন আগ্রহ কমে গেল?

তোফায়েল আহমেদ: নানা কারণ আছে। একটি হলো ভোটার ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখেন তাঁর ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। আরেকটি হলো ভোটকেন্দ্রের বাইরে প্রার্থীবিশেষের সমর্থকদের আধিপত্য। তারা জবরদস্তি করে, ভয়ভীতি দেখায়। এ অবস্থায় অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যেতে চান না। তাঁরা ভাবেন ভোট দিলেও যা, না দিলেও তা। ভোটের ফল আগেই নির্ধারিত। তৃতীয় কারণ হলো, প্রার্থীদের প্রতি অনাস্থা ও অনীহা। ২০১৪ সালের পর থেকে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। মানুষ ভোট দিয়ে কিছু পাবে, সেটি আর এখন আশা করে না।

প্রথম আলো: এর অর্থ কি এই নয় যে ভোটকেন্দ্র আর ভোটারদের দখলে থাকছে না?

তোফায়েল আহমেদ: সাধারণ ভোটাররা যাচ্ছেন না। কেন্দ্রে তাঁরাই যাচ্ছেন, যাঁরা ভোটকে প্রভাবিত করতে পারেন। প্রার্থীর সঙ্গে দলের কর্মী-সমর্থকেরা সারাক্ষণ চেষ্টা করছেন ভোটকে প্রভাবিত করতে। চট্টগ্রাম উপনির্বাচনের ফলাফল দেখুন। ২২.৯৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই প্রার্থীরই এলাকায় প্রভাব আছে। তাঁদের সুনামও আছে। তারপরও ২২–২৩ শতাংশ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। এ থেকেই ধারণা করা যায় যে ভোটের প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা আছে। আমি বলব ভোটের খরা চলছে এখন। অর্থাৎ দলের অন্ধ সমর্থকেরা এখন
ভোটকেন্দ্র দখল করে রাখেন। তাঁরাই ভোট করেন। দুই দলের বাইরের মানুষ আসেন না। এর অর্থ রাজনীতি জনগণ থেকে দূরে চলে গেছে।

প্রথম আলো: এ অবস্থা চলতে থাকবে? প্রতিকার কী?

তোফায়েল আহমেদ: প্রতিকার হলো রাজনীতিকে জনসম্পৃক্ত করতে হবে। রাজনীতি থেকে জনগণের পাওয়ার আছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে করণীয় আছে। সেই আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। দলগুলোর ভেতরেও গণতন্ত্র নেই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা ফের চালু করতে হবে।

প্রথম আলো: দলের ভেতরে গণতন্ত্র তো কখনোই ছিল না।

তোফায়েল আহমেদ: না থাকলেও আগের অবস্থা থেকে বর্তমান ভিন্ন। আগে নেতা নির্বাচনে একধরনের ঐকমত্য ছিল। এখন সেটি নেই। নেতার প্রতি কর্মীদের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। এখন সেই নেতৃত্বের ঘাটতি প্রকট। আগের নেতারা যে দলেরই হোক, তাঁদের টাকা দিয়ে ভোট কিনতে হয়নি। তাঁরা দলকে সময় দিতেন। এখন যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা পার্টটাইম রাজনীতিক, ফুলটাইম ব্যবসায়ী। ব্যবসার উন্নতির জন্যও অনেকে রাজনীতিতে আসেন।

প্রথম আলো: আগে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রাজনৈতিক দলগুলো চাঁদা নিত। এখন ব্যবসায়ীরাই রাজনীতি করছেন। তাতে সমস্যা কী?

তোফায়েল আহমেদ: কিন্তু আগে যাঁরা চাঁদা নিতেন, তাঁরা চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। তাঁরা চাঁদা নিয়ে দলীয় তহবিলে জমা দিতেন। মানুষও ভাবত টাকাটা দেশের মঙ্গলের জন্য ব্যয় হবে। তখন চাঁদা নিলেও ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা হতো না।

প্রথম আলো: ঢাকা শহরের একজন বাসিন্দা হিসেবে ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনকে কীভাবে দেখছেন।

তোফায়েল আহমেদ: বাসিন্দা হিসেবে আমি চাইব সুষ্ঠু নির্বাচন হোক। যোগ্য প্রার্থী বিজয়ী হয়ে আসুক। কিন্তু এখন তো সে রকম প্রার্থী দেওয়া হচ্ছে না, বিশেষ করে কাউন্সিলর পদে। আমার এলাকায় যাঁরা কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন, আমি চিনি না। তাঁদের কোনো জনসম্পৃক্ততা নেই। তবে মেয়র পদে যে চারজন প্রার্থী আলোচনায় আছেন, তাঁরা চৌকস প্রার্থী। কিন্তু জনসেবায় তাঁদেরও অভিজ্ঞতা নেই। পরীক্ষিত নন। দুই দল অভিজ্ঞ কোনো রাজনীতিককে প্রার্থী করতে পারেনি। এটাও একধরনের বিরাজনীতিকরণ। মেয়র হিসেবে আনিসুল হক বেশ কিছু ভালো কাজ করেছেন, কিন্তু তিনি রাজনীতি করতেন না। মেয়র হয়ে রাজনীতিক হয়েছেন। এর অর্থ হলো রাজনৈতিক দলগুলো সেই ধরনের প্রার্থী তৈরি করতে পারেনি, যাঁরা জয়ী হবেন।

প্রথম আলো: আমাদের স্থানীয় সরকার সংস্থার কাঠামোর দুর্বলতা কোথায়?

তোফায়েল আহমেদ: আমাদের এখানে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীই মুখ্য। তাঁরাই নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। নির্বাচিত হলে তাঁরা শহরকে এভাবে গড়ে তুলবেন। কিন্তু সিটি করপোরেশন তো মেয়র-কাউন্সিলর সবাইকে নিয়ে। কাউন্সিলরদের কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। তাঁরা অগুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছেন। মেয়রের নীতি পুরো কাউন্সিলরকে মেনে নিতে হয়। উত্তর ও দক্ষিণে ৫৪ জন সাধারণ ও ১৮ জন করে সংরক্ষিত আসনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন। আমি মনে করি, সরাসরি ভোটে কাউন্সিলরদের নির্বাচিত করা উচিত। এরপর কাউন্সিলরদের ভোটে একজন মেয়র নির্বাচিত হবেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে সেটাই হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের এখানে জাতীয় পর্যায়ে সংসদীয় পদ্ধতি চালু থাকলেও স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো চলছে রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতিতে। এতে ব্যক্তি প্রধান হয়ে উঠেছেন। আবার নগরের সব সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব তো সিটি করপোরেশনের নয়। যানবাহন সমস্যা, পানি সরবরাহ, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে নিজ নিজ সংস্থাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সিটি করপোরেশন সমন্বয় করতে পারে মাত্র।

প্রথম আলো: কিন্তু সমন্বয়ের কাজটি হচ্ছে কি? গত বছর ডেঙ্গুর প্রকোপের সময় স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখেছি। এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর দোষ চাপিয়েছে।

তোফায়েল আহমেদ: সিটি করপোরেশন এলাকার নাগরিকদের সেবা দেওয়ার জন্য ২৭টির বেশি সংস্থা আছে। সিটি করপোরেশন আইনের ১৫ ধারায় তাদের সিটি করপোরেশনের সভায় উপস্থিত থাকার কথা বলা আছে। স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ ইত্যাদি আছে। সরকারি সংস্থাগুলোর উচিত আগাম প্রস্তুতি নেওয়া। সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু রোধ করবে না। ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা যাতে না জন্মাতে পারে, সে জন্য রাস্তাঘাট, খোলা জায়গা পরিষ্কার রাখবে। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলে সমন্বয়ের কাজটি হয় শেষ পর্যায়ে, যখন পরিস্থিতি নাজুক হয়। গত বছর ডেঙ্গুর সময়ও তা-ই হয়েছে। এক সংস্থা তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করলে অন্য সংস্থাও অকার্যকর হয়ে পড়ে।

প্রথম আলো: সিটি করপোরেশনকে নগর সরকার করা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কাজটি হলো না কেন?

তোফায়েল আহমেদ: অনেকেই আলোচনা করেছেন। কেউ রূপরেখা দেননি। রাজনৈতিক বক্তৃতা দিচ্ছেন। আমি একটি ছোট্ট বই লিখেছি নগরায়ণ ও নগর সরকার: বাংলাদেশের সিটি করপোরেশন। প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে। এতে নগর সরকারব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা আছে। কলকাতা, মুম্বাই ও লন্ডনের উদাহরণ টেনে। সিটি করপোরেশন পরিচালনার দুটি মডেল আছে। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন। এরপর মেয়র কাউন্সিলরদের মধ্য থেকে ১০টি স্থায়ী কমিটি করবেন, যাঁরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দেখভাল করবেন। অনেকটা মন্ত্রিপরিষদের মতো। তাঁরা সার্বক্ষণিক অফিস করবেন। আমাদের দেশে মেয়র সভা পরিচালনা করেন। কলকাতায় মেয়র সেটি করেন না। সাধারণ কাউন্সিলর করেন। কাউন্সিল অধিবেশন অনেক বেশি কার্যকর। প্রতিটি কমিটিতে একজন সভাপতি থাকেন। আরেকটি হলো নির্বাহী মডেল। কাউন্সিলররা শুধু নীতি গ্রহণ করেন এবং সেটি বাস্তবায়নের জন্য লোক নিয়োগ করা হয় চুক্তিভিত্তিক। নিউইয়র্কে এটি হচ্ছে। আমরা কী চাই, সেটা তো বলতে হবে। আমাদের নগরায়ণ হচ্ছে দ্রুত। আগে বাংলাদেশটা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। এখন এক শহরের সীমানা আরেক শহরে গিয়ে পড়ছে। কিসের ভিত্তিতে এগুলো চালু করব, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অস্থায়ী ভিত্তিতে কিছু হবে না। আমরা নগর সরকার চাইছি, পাচ্ছি না। এর রূপরেখার জন্য একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এখন গ্রাম ও শহরের স্থানীয় সরকারের কাঠামো ভিন্ন হবে।

প্রথম আলো: উপমহাদেশে বাংলাদেশেই সর্ববৃহৎ নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তারা নির্বাচনটি ঠিকমতো করতে পারছে না। এর কারণ কী বলে মনে করেন?

তোফায়েল আহমেদ: আমাদের নির্বাচনব্যবস্থা একটি উপদ্রবে পরিণত হয়েছে। একটি সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকে। এই পাঁচ বছর ধরেই নির্বাচন হয়। এটি হতে পারে না। শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। হেভিওয়েট প্রার্থী দিয়ে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের নামে পুরো শহরকে অস্থির করা কোনো কাজের কথা নয়। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোকেও ‘সংসদীয় ব্যবস্থায়’ নিয়ে যেতে হবে। কাউন্সিলর থেকে মেয়র হবেন, ইউপিতেও সদস্যদের থেকে চেয়ারম্যান হবেন। তাতে উত্তেজনা কম হবে। খরচ কম হবে। সংঘাত–সংঘর্ষের ঘটনাও কমবে। মানুষ তখন তিনটি ভোট দেবে না। একটি ভোট দেবে। অভিন্ন তফসিলে ভোট হবে। তখন এক মাসের মধ্যে সব ভোট হয়ে যাবে। নির্বাচন নিয়ে আর বিশৃঙ্খলা হবে না।

প্রথম আলো: সিটি নির্বাচনের প্রচার ও কার্যক্রমে সাংসদদের অংশগ্রহণ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে।

তোফায়েল আহমেদ: আমি মনে করি, এটি বিতর্কের বিষয় নয়। তবু বিতর্কিত করা হচ্ছে। ২০১৬ সালের আইনে বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তথা স্পিকার, মন্ত্রী মেয়র ও সাংসদেরা নির্বাচনের কাজে অংশ নিতে পারবেন না। সরকারি দলের দুজন সাংসদকে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়াও ঠিক হয়নি বলে মনে করি। তাঁরা জাতীয় পর্যায়ের নেতা।

প্রথম আলো: নির্বাচন কমিশন কি নির্বাচন পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে?

তোফায়েল আহমেদ: আমি ঢালাওভাবে বলব না। তবে এটুকু বলব, তাদের কথা ও কাজে মিল থাকে না। নির্বাচন কমিশন এমন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, জনগণের আস্থাই তাদের মূল শক্তি। যখন বিভিন্ন মহল থেকে কমিশনের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে কথা হচ্ছে, তখন তাদের সাড়া দিতে হবে। জবাব দিতে হবে। কিন্তু তারা কিছু বলে না। ফলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। একটি উদাহরণ দিই। চট্টগ্রামে উপনির্বাচন হয়ে গেল। সেখানে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। কীভাবে ঘটল, কারা দায়ী, সেটি চিহ্নিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে কৈফিয়ত চাইতে হবে। সেটি তারা চায় না। ফলে বিভ্রান্তিও বাড়ছে।

প্রথম আলো: ইভিএম নিয়ে বিতর্ক চলছে। এক পক্ষ সমর্থন করছে, আরেক পক্ষ বিরোধিতা করছে।

তোফায়েল আহমেদ: এখানেও দেখছি সরকারি দলের নেতারা বেশি কথা বলছেন। মন্ত্রীরা বলছেন। নির্বাচন কমিশন চুপ থাকছে। কিন্তু কমিশনকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। ইভিএম নিয়ে জনমনে যেসব প্রশ্ন আছে, তার উত্তর দিতে হবে।

প্রথম আলো: তাঁরা তো বলছেন ইভিএমে ভোট কারচুপি হবে না।

তোফায়েল আহমেদ: শুধু কথা বললেই হবে না। জনগণের মধ্যে ইভিএম নিয়ে যে অনাস্থা আছে, অবিশ্বাস আছে, সেটি দূর করতে তারা কী করেছে, সেটিও তাদের জানাতে হবে। অনেক দেশ ইভিএম বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতেও ইভিএম নিয়ে যে বিতর্ক ছিল, সেটি সেখানকার কমিশন সমাধান করেছে। তারা ইলেকট্রয়াল পেপার চালু করেছে। প্রমাণ হিসেবে ভোটারদের হাতে সেটি দেওয়া হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই সেটি হয়েছে। আমাদের এখানে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের এখানে পুনর্গণনার ব্যবস্থা কী হবে, তা–ও জানা নেই। আমি কাকে ভোট দিলাম সেটি জানতে হবে। এগুলো ঠিক করেই নির্বাচন করা উচিত। জাতীয় নির্বাচন অপেক্ষাকৃত সহজ। সেখানে একটি ভোট। এখানে তিনটি ভোট হবে। গত সাধারণ নির্বাচনে ভোটারদের অনেকেই আঙুলের ছাপ দিয়ে ভোট দেননি। ২৫ শতাংশের মতো। সংখ্যাটি কম নয়। ভোটকেন্দ্রে দীর্ঘ লাইন থাকে। অনেকে অপেক্ষা করে চলে যান। কারা সেই লাইনে থাকেন, কেউ ইচ্ছা করে ভোট দিতে বাধা দিচ্ছে কি না, সেটিও কমিশনকে দেখতে হবে। যখন লাইনের ভেতরে অনেক লোক থাকে।

প্রথম আলো: নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কমিশনের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে?

তোফায়েল আহমেদ: বাস্তবে উল্টো হচ্ছে। কমিশন নিজেদের দিক থেকে পরিবেশ ঠিক রাখতে পর্যবেক্ষক রাখবে। ম্যাজিস্ট্রেট পাঠাবে। কিন্তু কিছুই তারা করছে না। অধ্যাপক রামচন্দ্র গুহ ভারতের ৩৯২টি নির্বাচন বিশ্লেষণ করে একটি বই লিখেছেন। তাতে বলা হয়েছে, ভারতের জনগণের সবচেয়ে আস্থাভাজন ও যোগ্য প্রতিষ্ঠান হলো নির্বাচন কমিশন। আমরা কেন পারছি না? ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ কেন থাকে না? কেন্দ্রের পরিবেশের ওপর ভোটের প্রকৃতি নির্ভর করে। মেশিন বা মানুষ নয়।

প্রথম আলো: সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে আপনি আশাবাদী না শঙ্কিত?

তোফায়েল আহমেদ: আমার শঙ্কাও নেই, আশাও নেই। কিছু আশা করছি না। প্রচারের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করলে দেখব গতবারে যারা আছে, প্রচুর লোক হচ্ছে—কিন্তু এরা সাধারণ মানুষ নয়। দলীয় মানুষ। কাউন্সিলর ভোট হচ্ছে বলে ভোটারের উপস্থিতি বাড়বে। শুধু মেয়র নির্বাচন হলে ১৫–২০ ভাগের বেশি হওয়ার কথা নয়।

প্রথম আলো: কাউন্সিলর প্রার্থীদের মূল্যায়ন করুন। অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি ফের প্রার্থী হচ্ছেন।

তোফায়েল আহমেদ: যে পদ্ধতিতে ভোট হচ্ছে, তাতে কাউন্সিলর পদে তেমন ভালো লোক আসবেন না। সুযোগ পেলে সন্ত্রাসীরাই আসবেন। ব্যবস্থাটি পরিবর্তন করলে মেয়র ও কাউন্সিলর পদপ্রার্থীর মধ্যে ফারাক থাকত না। তখন কাউন্সিলরদের থেকেই একজন মেয়র হতেন। আমরা সিটি করপোরেশন তথা স্থানীয় সরকার সংস্থায়ও সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচন চাইছি। এখন তো একটি হযবরল অবস্থা। মেয়র পদে দলীয় প্রতীক আছে, কিন্তু কাউন্সিলর পদে নেই। দিলে বহু দলীয় ব্যবস্থা হতো। অনেক দেশে ৫০ শতাংশের কম ভোটার এলে পুনরায় ভোট হয়। এখানে ১০ শতাংশ ভোট পেলেই কেউ নির্বাচিত হয়ে যান। তাই বলব, নির্বাচনী ব্যবস্থাটি সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা নির্বাচন ছাড়া কিছু করছি না। নির্বাচন নিয়ে বহু কথা হচ্ছে, কাঠামো নিয়ে কাজ হচ্ছে না।

 যেহেতু ঢাকায় নির্বাচনটি হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচুর সদস্য এর দায়িত্বে থাকবেন। সংবাদমাধ্যমের নজরদারি থাকবে। সিইসিসহ পাঁচ নির্বাচন কমিশনারই ঢাকার বাসিন্দা। এ কারণে আশা রাখতে চাই, তাঁরা সভ্যতা-ভব্যতার পরিচয় দেবেন এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবেন। তারপরও যদি না হয়, বলব দুর্ভাগ্য; কপালের লিখন।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

তোফায়েল আহমেদ: ধন্যবাদ।