এডিপি বাস্তবায়নের ধীরগতি

চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস পার হয়েছে। অর্থনীতির সূচকগুলো নিম্নগামী। নিম্নগামিতার ধারাকে আরও নিশ্চিত করছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর আর্থিক অব্যবস্থাপনা। প্রথম আলোর শনিবারের এক সংবাদ জানাচ্ছে, ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ তাদের বরাদ্দের ১০ শতাংশ টাকাও খরচ করতে পারেনি। এডিপির বরাদ্দের এক-দশমাংশও ব্যয় করতে না পারার অর্থ হলো, সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এসব মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কমে যাবে; খরচ করা যায়নি বলে অনেক টাকা ফেরত যাবে। ফলে এসব মন্ত্রণালয়ের দ্বারা জনগণের করের টাকা জনগণের কাজে ব্যয় হতে পারবে না। জনগণ তাদের পাওনা সেবা পাবে না।

একদিকে আমরা দেখছি রাজস্ব আদায়ে মন্দাভাব, অন্যদিকে সরকারের প্রশাসন পরিচালন ব্যয়, তথা রাজস্ব ব্যয় অনেক বাড়ছে। মন্ত্রণালয় এবং তাদের অধীনস্থ আমলাতান্ত্রিক বিভাগের পেছনে খরচ বাড়লেও তাদের নেওয়া প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বাস্তবায়িত না হওয়া প্রকল্পের অনেক টাকা এভাবে ফেরত যায় এবং বছরের পর বছর ধরেই তা হয়ে আসছে। এবারের এডিপিতে এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ১২৭টি প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১০ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। গত ছয় মাসে এসব বরাদ্দ থেকে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৬০৩ কোটি টাকা। এমনকি এই ১০ মন্ত্রণালয়, বিভাগসহ সার্বিকভাবে এডিপি বাস্তবায়নের হারও বিগত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রকল্পের টাকা খরচে অহেতুক জটিলতা এড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা বাতিল করা হলেও প্রশাসন তার সুফল নিতেও পারেনি, জনগণকে দিতেও পারেনি।

অর্থবছর শুরুর পর প্রকল্পের টাকা ব্যয় না হওয়াটা স্পষ্টতই অদক্ষতা। ফাইল নড়বে না, যথাসময়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না। আবার বলা হবে, প্রক্রিয়াগত জটিলতায় অর্থ খরচ করা যায়নি। এই অর্থ তো জনগণের, কিন্তু জনগণের কাছে তার প্রতিদান পৌঁছাতে পারছে না। যাঁদের কারণে এটা হচ্ছে, তাঁরা কোনো খেসারত দিচ্ছেন না, খেসারত দিচ্ছে জনগণ। এভাবে টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণের পর অর্থবছরের শেষাশেষি তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করা হয়। ঠিকাদার ও সরবরাহকারীরা তখন অল্প সময়ে যেনতেন প্রকারে কাজ শেষ করেন অথবা কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই বিল নিয়ে যান। কাজের গুণগত মানও তখন নিশ্চিত করা যায় না। ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীদের এই সুযোগ করে দেওয়া তো দুর্নীতিরই অপর নাম।

মাথাভারী প্রশাসন চালাতে খরচ হয়ে যাচ্ছে অনেক টাকা। বর্তমানে উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক বেশি এবং তাঁদের জন্য ব্যয়ও সর্বকালের মধ্যে বেশি। কিন্তু সেই প্রশাসনের জবাবদিহি হবে না, তা হয় না। এই অব্যবস্থাপনার ক্ষতি বহুমাত্রিক। এমন সব প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, যা বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আবার ওই সব বরাদ্দ দিতে গিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও শিল্প খাতে বরাদ্দ কমে যায়। ফেরত যাওয়া ও খরচ করতে না পারা টাকা তো আর ঘাটতিতে থাকা খাতে ব্যয়ের ব্যবস্থা নেই! ফলে দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের জন্য যতটুকু করা হবে বলে বলা হয়, সেটাও করা হয় না। অথচ বাজেট প্রণয়নের সময় কোন খাতে কত টাকা দেওয়া হয়েছে বলে কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।

যে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর বাস্তবায়ন সক্ষমতার অভাব রয়েছে সেগুলোকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি সমস্যার মূল দিকগুলো খুঁজে বের করতে হবে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ধরে ধরে সক্ষমতার ঘাটতি কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেই পথ খুঁজতে হবে। সামগ্রিক ও সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই।