খেলা চলাকালে নিয়ম পাল্টানো যায় না

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী কর্মকর্তারা এখন ভোট গ্রহণের কর্মী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করছেন। আর প্রার্থীরা চালাচ্ছেন প্রচার-প্রচারণা। এরই মধ্যে নির্বাচন পিছিয়েছে, জানুয়ারির ৩০ তারিখের বদলে এখন ভোট হবে ১ ফেব্রুয়ারি।

দুই সিটিতেই মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির একজন করে প্রার্থী। দুটি দলই একটু গোছগাছ করেই নেমে পড়েছে নির্বাচনের লড়াইয়ে। দুই সিটির জন্য পৃথকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাতে সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে দুই দলই। বিপত্তি বাধল ক্ষমতাসীন দলের কমিটি দুটিতে আহ্বায়কসহ সদস্যপদে কয়েকজন সাংসদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে। অথচ এ নির্বাচনের আচরণবিধিমালায় সাংসদের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সিটি নির্বাচনে ভোটার হলে ভোট দেওয়া ব্যতীত কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন না। প্রচার-প্রচারণার জন্য সমন্বয় কমিটি দলীয় প্রার্থীর সপক্ষে কাজ করার জন্যই গঠিত হয়েছে, কিন্তু দলের নেতারা এর আইনগত দিকটি হয়তোবা তলিয়ে দেখেননি। তাঁদের দুই কমিটির দুজন আহ্বায়ক অতিমর্যাদাসম্পন্ন জাতীয় নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের প্রথম সারিতে ছিলেন। পক্ষান্তরে বিরোধী দলের গঠিত কমিটি দুটির আহ্বায়কেরাও সমাজে বিশিষ্টজন, অতিমর্যাদাসম্পন্ন এবং সাবেক মন্ত্রী। তবে বিধিমালার সংজ্ঞায় সিটি নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে তাঁরা এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন। সেই হিসেবে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে তাঁদের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।

উল্লেখ্য, এই বিধি একেবারে নতুন নয়। এর আওতায় আরও সিটি নির্বাচন হয়েছে। বিধানটি লঙ্ঘিতও হয়েছে ক্ষেত্রবিশেষে। তবে এর যৌক্তিকতা নিয়ে আগে কোনো আপত্তি আসেনি। এবার এল। আর তা ক্ষমতাসীন দল থেকে। তারা বলতে চায়, কোনো প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাওয়া ছাড়াও তারা নির্বাচনসংক্রান্ত অন্য যেকোনো সমন্বয়ের কাজ করতে পারবে। এ নিয়ে তাদের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনে গিয়েছিল। সেখানে সিইসিসহ অন্য কমিশনাররাও বলেছেন সাংসদেরা নির্বাচনে কোনো ধরনের কাজ করতে পারবেন না। ব্যাপারটি এখানে মিটে গেলে ভালো হতো। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা বিধিমালার সংশোধনীর দাবি তোলায় বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে।

বিধিমালাটি চলমান নির্বাচনের মাঝখানে সংশোধনের কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আর এ নির্বাচন শেষ হয়ে গেলেও এটা রদ বা কোনোভাবে হালকা করা যথার্থ হবে না। এটার একটা জোরালো নৈতিক দিক আছে। এর মাধ্যমে সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলকে কিছু একটা রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের এটি একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র। বিরোধী দলের দুটো সমন্বয় কমিটি নিয়ে সরকারি দলের নেতারা যা বলেছেন, তা আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে টেকে না। এখানে সরকারি দলে না থাকলে বিরোধী দলের যেকোনো স্তরে থাকা ব্যক্তিদের অবস্থান ভঙ্গুর। আমাদের সব সরকারের সময় সাবেক মন্ত্রীদের কেউ কেউ পুলিশের লাঠিপেটার শিকারও হয়েছেন। অশীতিপর কোনো নেতাকে সুদূর কোনো স্থানে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ মামলার আসামি করা হয়েছে। রাতের অন্ধকারে চোখ বেঁধে নেওয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। আদালতে হাজির করা হলেও রিমান্ডে নিয়ে করা হয় হেনস্তা। রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আমরা কদর্য করে ফেলেছি। আজ কাশ্মীর নিয়ে অনেক কথা হয়। অভিযোগ আছে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের। অভিযোগগুলো অসত্য নয়, কিন্তু কাশ্মীরের রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনজনিত সিদ্ধান্তের পরপর ভারত সরকার সেখানকার বিরোধী নেতাদের কারাগারে না নিয়ে বন্দী করে রেখেছে নিজ গৃহে। এটাও সমর্থনযোগ্য নয়। তবে তাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দিকটি আমাদের চেয়ে উন্নত। নির্বাচন নামক ব্যবস্থাটিও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। শেষ অবধি সিটি নির্বাচনে কী হয়, তা অনিশ্চিত। তবে শুভ লক্ষণ হচ্ছে, উভয় পক্ষ সংগঠিত হয়ে লড়াইয়ে নেমেছে। এ নির্বাচনের ফলাফল জাতীয় সরকারের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। আর ভালো নির্বাচন করেও সরকারি দলের প্রার্থীরা জিতবেন না, এমনও বলা যায় না। তবে আমরা একটি ‘ফেয়ার গেম’ চাই।

বিধিমালায় যা-ই থাক, তার যথাযথ প্রয়োগ নির্ভর করছে নির্বাচন কমিশনের ওপর। কমিশনের কর্মকর্তারাই দুই সিটি নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা। এমনটা তাঁরা ছিলেন রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, গাজীপুরেও। সেখানে কী ঘটেছিল, এটা আজ আবার নতুন করে লেখার প্রয়োজন নেই। ভুলে যাওয়ার নয় জাতীয় নির্বাচনের স্মৃতিও। এটা সত্যি যে এ নির্বাচনগুলো নিয়ে কোনো কার্যকর প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। তাই আপনা থেকেই বৈধতা পেয়ে গেছে। আর এর ব্যর্থতার দায় অংশত বিরোধী দলের। তারা একের পর এক নির্বাচন বর্জন করে, আন্দোলনকে সহিংস পথে পরিচালনা করে, লাগাতার হরতাল-অবরোধ করে হারিয়েছে জনগণের সমর্থন ও সহানুভূতি। এমনকি বিপন্ন হয়েছে সাংগঠনিক ভিত।

বাস্তবতা পরিবর্তনশীল। গতকাল যা প্রাসঙ্গিক ছিল আজও তা-ই থাকবে, এমন নয়। আর আমরা অন্তত কার্যকর একটা বিরোধী দলের অভাবে ভুগছি, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আর সে ধরনের বিরোধী দল ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারও বিকাশ ঘটে না। এ বিষয়ে আমরা এগিয়েই ছিলাম। অত্যন্ত শক্তিশালী দুটি রাজনৈতিক দল ছিল আমাদের। কিন্তু এক মহাঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেল সব। অন্য কোনো সংগঠনও পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসতে পারছে না। ফলে শুধু সরকারি দলকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা। এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভারসাম্যের জন্য ইতিবাচক নয়।

ঢাকার দুটো সিটি করপোরেশন নির্বাচন রাষ্ট্রক্ষমতায় কোনো প্রভাব না ফেললেও জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের রাজধানীর দিকে নজর থাকে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমসহ কূটনীতিকদেরও। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাম্প্রতিক কালের দুর্বলতাগুলো তাদের নজরে আছে। এর পাল্লা আর ভারী করা সংগত হবে না। সরকারি দলে অনেক বিচক্ষণ দেশপ্রেমিক নেতা আছেন। তাঁরা বিপন্ন ব্যবস্থাটি আবার সঠিক রাস্তায় আনতে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারেন। বিরোধী দলেরও কথায় কথায় বর্জনের তরিকা ভুলে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার নীতি নেওয়া উচিত। আর সংবিধান যাদের সর্বময় ক্ষমতা দিয়েছে, সে নির্বাচন কমিশন আচরণবিধির একটি অংশ নিয়ে যে অবস্থান নিয়েছে, তার দৃঢ় প্রয়োগ নিশ্চিত করুক। এটা নতুন একটি চ্যালেঞ্জ। তবে অপব্যবহার হয় না, এমনটা নিশ্চিত করতে পারলে মানুষ প্রযুক্তিকে গ্রহণ করে নেবে। এতে দ্রুত ভোটের ফলাফল আসবে। নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লার প্রথম সিটি নির্বাচনে এটি ব্যবহার করা হয়েছিল। জনপ্রিয়তা পেতে যাচ্ছিল ব্যবস্থাটি। মধ্যে সব ওলটপালট হয়ে গেল।

নির্বাচনে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, তাঁরা জয়ী হতে চাইবেন। এটা সরকারি ও বিরোধী দল উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। আর আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে কোনো ফাঁকফোকর পাওয়া গেলে তার ব্যবহার বা অপব্যবহার করতে পারে যেকোনো পক্ষ। এমনটা যাতে না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে কমিশনকে। যদিও অধস্তন কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা, কমিশনের নাকের ডগায় এ নির্বাচনের দিকে তাঁদের সতত বিরামহীন নজরদারি করতে হবে। বিধিবিধান যেখানে সুস্পষ্ট আছে, সেখানে এটা লঙ্ঘন আইনের চোখে অপরাধ। আর এমনটা অবগত হলে কমিশনের কারও চিঠিপত্রের জন্য অপেক্ষা না করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা সংগত। এ সমন্বয় কমিটিগুলো গঠন করা হয়েছে বেশ কদিন আগে। সব পত্রপত্রিকায় এসেছে। তখনই বিষয়টি আচরণবিধি পরিপন্থী বলে কমিশন সংশ্লিষ্ট দলকে জানালে একটু কঠোর বার্তা যেত। যেটাই ঘটেছে তবু আমরা চাই, চলমান প্রক্রিয়ার ওপর কমিশন বাস্তব ও দৃশ্যমান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করুক।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]