মন্দ ঋণ ব্যবস্থাপনায় যা করা যায়

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা আমাকে প্রায়ই প্রশ্ন করেন, কেন একটি ঋণ মন্দে পরিণত হয়? কীভাবে আমরা ঋণ ক্ষতি এড়াতে পারব? রিস্ক অফিসার বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা হিসেবে আমি প্রায় ২৮ বছরের ব্যাংকিং জীবনে ১৫ বছর কাজ করেছি। দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা আমাকে একটি বিষয় শিখিয়েছে, ঋণ সাধারণত মন্দ হয় যেসব কারণে তা হলো— ১. ঋণ প্রদানে প্রয়োজনীয়তার দুর্বল মূল্যায়ন; ২. ঋণের কাঠামো বিবেচনায় দুর্বলতা; ৩. নিরাপত্তা বা জামানতের ঘাটতি ৪. ব্যবসায় অভ্যন্তরীণ নগদ অর্থের অপর্যাপ্ততা; ৫. ব্যবসার ভিত্তি, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অথবা ধারাবাহিকতার দিকে না তাকিয়ে শুধু ঋণগ্রহীতার নামের ওপর ভর করে ঋণ প্রদান; ৬. চলমান প্রতিযোগিতা অথবা উদীয়মান প্রতিযোগিতা সম্পর্কে ঋণ কর্মকর্তার অজ্ঞতা বা ভুল মূল্যায়ন; ৭. অর্থনৈতিক মন্দা অথবা মূল ব্যবসার বাইরে অন্যান্য ব্যবসায় বিনিয়োগ বা ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা বিবেচনায় না নেওয়া।

এ কারণগুলোর সঙ্গে আরও যোগ করতে হবে দুর্বল ঋণ মূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ঝুঁকি বুঝতে না পারার ব্যর্থতা, ঋণ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি বা ব্যর্থতা, জামানতের বা চুক্তির শর্ত পূরণ করতে না পারলেও ঋণ দেওয়া অথবা যথাযথ নজরদারির অভাব। একজন গ্রাহক হয়তো যেকোনোভাবে ঋণ অনুমোদন বা ছাড় করতে চাইবেন। এটি ঋণ কর্মকর্তার দায়িত্ব ওই পোর্টফোলিওর সংশ্লিষ্ট সব ধরনের ঝুঁকি যাচাই করা এবং ওই ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। আমি দেখেছি ঋণ ফেরতে ভুল শর্ত বা কাঠামোগত দুর্বলতার কারণে এক বৃহৎ টেক্সটাইল গ্রাহকের ঋণ কীভাবে বারবার অনাদায়ি হয়ে যাচ্ছিল।

ট্রেড সাইকেল অনুযায়ী, এন্ড টু এন্ড ট্রানজিকশনে (কাঁচামাল আমদানি থেকে রপ্তানি আয় দেশে আনা পর্যন্ত) সময় লাগে ১০৫ দিন, আর ঋণ যদি ফেরত দিতে হয় ৯০ দিনের মধ্যে, এটি উভয় পক্ষের জন্য সমস্যা তৈরি করে। একইভাবে আমরা দেখেছি যথাযথ উত্তরাধিকার না থাকায় একজন বড় ট্যানারি গ্রাহকের হঠাৎ মৃত্যুর পর কীভাবে স্থানীয় একটি বৃহৎ ব্যাংককে বিশাল অঙ্কের অর্থ গচ্চা দিতে হয়েছিল। একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের একজন বড় ঋণগ্রহীতা মেয়াদি ঋণ ছাড় করার পরপরই ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন, কেননা, জার্মানির মুদ্রায় বিনিময় হারের উত্থান-পতনের বিপরীতে তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, যার ফলে তাঁর প্রকল্প ব্যয় ধারণার তুলনায় কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল।

একটি বিদেশি কোম্পানির একজন বৃহৎ ডিস্ট্রিবিউটর ঋণখেলাপি হয়েছিল, কারণ, ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া তার সব অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল জমি কিনতে; গ্রাহক পণ্য বিতরণ ব্যবসায় নয়। ঋণ কর্মকর্তারা প্রায়ই বড় গ্রাহকদের কাছে বাঁধা থাকেন তাঁদের অনুমিত পেশি বা ব্যবসায়িক শক্তির কারণে। এমনকি কর্মকর্তাদের মাঝেমধ্যে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলও করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বড় গ্রাহকেরাই ঋণের শর্ত ঠিক করে দেন। কোনো গ্রাহকের ১০০ টাকার প্রয়োজন হয়, আর যদি ব্যাংক তাঁকে ২০০ টাকা দেয়, তবে গ্রাহকের ওই অতিরিক্ত টাকা ব্যবসার বাইরে ব্যয় করার জোর সম্ভাবনা তৈরি হয়।

গ্রাহক যে–ই হোন অথবা যে ব্যবসাই করুন না কেন, ঋণ কর্মকর্তাকে ব্যবসার জন্য গ্রাহকের কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন এবং কী আদলে তা দেওয়া হবে, তা নিয়ে অবশ্যই গভীরভাবে পর্যালোচনা করতে হবে। কথায় বলে আপনি যদি একবার টুথপেস্ট থেকে অতিরিক্ত পেস্ট বের করে ফেলেন, তবে তা আর ভেতরে প্রবেশ করাতে পারবেন না। একইভাবে যদি আপনার কানে কিছু পানি প্রবেশ করে, তবে ওই পানিকে বের করার জন্য আপনাকে আরও কিছু পানি প্রবেশ করাতে হবে। তাই ঋণ দেওয়ার আগে ঋণ কর্মকর্তাকে বিজনেস মডেলের দিকে তাকাতে হবে, দেখতে হবে অনুমিত টার্নওভার কত, এন্ড টু এন্ড ট্রানজিকশনের মেয়াদ এবং এরপর সব হিসাব মিলিয়ে একটি অঙ্ক দাঁড় করাতে হবে এবং প্রকল্প ঋণের ক্ষেত্রে অবশ্যই জানতে হবে এ অঙ্কের কতটা ব্যাংক অর্থায়ন করবে এবং কতটা মালিক বা উদ্যোক্তা। প্রদত্ত জামানতের অবশ্যই যথাযথ বাজারমূল্য নিরূপণ করতে হবে। একইভাবে জামানতসংশ্লিষ্ট অন্যান্য অনিষ্পন্ন বা আউটস্ট্যান্ডিং বিষয়গুলোও পর্যালোচনা করতে হবে।

বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থা থাকা, নদীদূষণ না করা, কর্তৃপক্ষের এমন বাধ্যবাধকতা না মানার কারণেও অনেক দেশে ঋণ মন্দে পরিণত হতে দেখা যায়। সামাজিক গোষ্ঠীগুলো এসব শর্ত না মানা কারখানা বন্ধ করতে কর্তৃপক্ষকে যেকোনো সময় বাধ্য করতে পারে। ভুল ভূমি অধিগ্রহণ, যেমন স্কুল বা প্রার্থনার জায়গা নিয়ে কারখানা স্থাপন করতে গেলে বাধা আসতে পারে। এর ফলে কোম্পানিকে কারখানা অন্য কোথাও
সরিয়ে নিতে হতে পারে, যার ফলে অবধারিতভাবে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়।

আরেকটি বিষয়, উদ্যোক্তা যেসব খাতে শক্তিশালী, তার বাইরের ব্যবসা করলে ঋণ যথাসময়ে ফেরত দেওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিটি ব্যবসায়িক লগ্নিতে অগ্রসর গ্রাহকদের সঙ্গে থাকতে হবে, পরাজিতদের সঙ্গে নয়। কেউ যদি কিছুটা ছাড় দিয়ে গ্রাহকের পছন্দনীয় খাতে ঋণ দিতে চায়, তবে মূল্যে বা সুদের হারে অন্তর্নিহিত ঝুঁকিটিকে বিবেচনায় নিতে হবে অথবা ওই সব খাতে অর্থের প্রবাহকে উৎসাহিত করতে সরকারকে অবশ্যই ভর্তুকি দিতে হবে।

বাংলাদেশে অনেক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এখনো নিজেদের যথাযথ কোনো রিস্ক পলিসি বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতি নেই অথবা ঋণ অনুমোদন, ছাড় ও আদায়ের কোনো কাঠামোগত পদ্ধতি নেই। আমি দেখেছি, অনেক প্রতিষ্ঠানের ঋণ বিভাগে প্রচুর লোক রয়েছে, কিন্তু প্রতিটি ঋণ অনুমোদন বোর্ডের ওপর নির্ভরশীল। অনেক প্রতিষ্ঠানেই প্রতিনিয়ত জামানতের মূল্যায়ন সংস্কৃতি অনুপস্থিত। ব্যবসা বা ট্রেড সাইকেল মূল্যায়ন করার আগেই ঋণ অনুমোদন করা হয়। এর ফলাফল হয় মন্দ ঋণ, জবরদস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, মূলধন ক্ষয়, মুনাফার পতন এবং চূড়ান্তভাবে শেয়ারের দরপতন।

একটি বলিষ্ঠ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সংস্কৃতি, একই সঙ্গে একটি শক্তিশালী ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নীতি প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের ক্ষতি এড়াতে সাহায্য করতে পারে। তবে এর চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ ব্যবস্থাপনায় সঠিক লোক নিয়োগ, ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং সামগ্রিক ব্যাংক পরিচালনা বা অপারেশনসকে কেন্দ্রীয়করণ।

মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক