জনসমর্থন বিএনপিকে জয়ী করবে না

রোববার ছিল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৮৪তম জন্মবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাতার ৮৫তম জন্মদিনে ৪১ বছর বয়সী দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এখন কোথায় দাঁড়িয়ে? ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিণত হতে না পারলে সংগঠন হিসেবে টিকে থাকা মুশকিল। রাজনীতির ময়দানে চাপ থাকে। দমন-পীড়নও হবে। উত্থান-পতনও থাকবে। রাজনীতি ফুলে মোড়ানো রোমান্টিক কোনো ভ্রমণ না। রাজনীতির পথে পথে কাঁটা বিছানো থাকে। এসব মোকাবিলা করে, কৌশল অবলম্বন করে টিকে থাকতে হবে। কিন্তু বিএনপি তার ইতিহাসের যে কঠিন সময় পার করছে, তার জন্য দলটির নিজস্ব দায় যথেষ্ট।

বিএনপির এই দুরবস্থা কেন? সহজ উত্তর হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে বিএনপি খাপ খাওয়াতে পারেনি। বিএনপির মূল সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দুর্বলতা। এমন সময় এমন সব পরিকল্পনা বিএনপি গ্রহণ করছে, যেগুলো কাজে লাগছে না। মোদ্দাকথা হচ্ছে, বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় বিএনপি খুবই দুর্বল। এর প্রভাব পড়ছে বিএনপির আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ যোগাযোগেও। নিকট অতীতে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গতিপ্রবাহও বিএনপি একেবারেই অনুধাবন করতে পারেনি। বরং চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

প্রথমেই আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে বিএনপির অবস্থান বিশ্লেষণ করা যাক। রাজনীতি নিছক কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় না। রাজনৈতিক দলকে আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতি সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে কৌশল সাজাতে হয়। আমেরিকার ৯/১১-এর পর বিশ্বরাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে বা ভবিষ্যৎ ভাবগতি কেমন হবে, এটা বিএনপির থিংকট্যাংক একেবারেই অনুধাবন করতে পারেনি। তাদের পূর্বানুমানও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের মিত্রদের বিষয়ে এবং তার বাইরেও ভুল জায়গায় বিএনপি মিত্রের সন্ধান করেছে। এসব ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার অভাব ছিল ভয়াবহ রকমের। এখনো আছে। তাই দেশের বাইরে বিএনপির মিত্র কমেছে।

শুধু বৈশ্বিক রাজনীতিই না, দলকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রেও বিএনপি দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছে না। দলটির মধ্যে দ্বিধা ও সংশয় স্পষ্ট। এ কারণেই বিএনপি জনমত সংগঠিত করতে পারছে না। বিএনপি এখন কোনো রকমে টিকে আছে। দলটির জনসমর্থন আছে বিপুল। কিন্তু সাংগঠনিক দক্ষতা ও শক্তি নিঃশেষপ্রায়। শুধু জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করেই কোনো রকমে টিম টিম করে জ্বলছে বিএনপি নামের দলটি। মাঠপর্যায়ে তেমন সাংগঠনিক তৎপরতা নেই। মাঝেমধ্যে কিছু জনসভা করে থাকে। এ ছাড়া আর তেমন কোনো রাজনৈতিক তৎপরতা নেই।

ভাবগতি দেখে মনে হচ্ছে, ক্ষমতা থেকে দীর্ঘদিন বাইরে থাকার কারণে বিএনপি ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। একবার বলে সংসদে যাবে। আবার বলে যাব না। এই যাব বা যাব না করে সংসদে গিয়ে হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে। বিএনপির গুটিকয়েক সদস্য সংসদে গিয়ে যে বিশাল কিছু করে ফেলেছেন, তেমন না। বরং বিভিন্ন হাস্যকর, অবাস্তব বক্তব্য দিয়ে নিজেদের ও বিএনপিকে খেলো একটি সংগঠনে পরিণত করেছেন।

মেঘে মেঘে অনেক বেলা বয়ে গিয়েছে। এই সুযোগে বিএনপির উচিত ছিল দল পুনর্গঠনে মনোযোগ দেওয়া। দলের ভেতর সংস্কার করা। তৃণমূল থেকে নতুন নেতৃত্ব বের করে আনা। তৃণমূলের ক্ষমতায়ন করা। জনগণের আরও কাছাকাছি থেকে রাজনীতি করা। বিএনপিকে জরুরি ভিত্তিতে এসব করা উচিত। অভিজাত, উচ্চশিক্ষিত, বিত্তশালী ব্যবসায়ীরাও বিএনপিতে থাকবেন। কিন্তু একই সঙ্গে সাধারণের কাতার থেকেও উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বে আনতে হবে।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল দুই কারণে। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আপসহীন নেতৃত্ব এবং ছাত্রদলের জনপ্রিয়তা। খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এখন অনুপস্থিত। বয়সের ভার ও রোগশোকে কাবু খালেদা জিয়া জেলে আছেন। এটা রাজনীতিতে হতে পারে। কোনো কারণে শীর্ষ নেতা অনুপস্থিত থাকতে পারেন। কিন্তু ছাত্রদলের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে বিএনপি আর এগিয়ে যেতে পারেনি। ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর অধিকাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বিএনপি বন্ধ করে দেয়। আর ছাত্রদলের নেতৃত্ব বয়স্ক, বিবাহিত ও অছাত্রদের হাতে দিয়ে ছাত্ররাজনীতির ভাবমূর্তিই নষ্ট করে দিয়েছে। এখানে বিএনপি একার দায় নেই। সব দল মিলেই ছাত্ররাজনীতির সর্বনাশ করেছে। কিন্তু অন্যরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও বিএনপি ছাত্রদলকে আর ছাত্রদের ধারায় ফিরিয়ে আনতে পারেনি। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ অছাত্র দিয়ে ক্যাডার রাজনীতি করানো যায়, ছাত্ররাজনীতি সম্ভব না।

কিন্তু জায়গা তো ফাঁকা থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল ছাত্রদলের, সেই জায়গা এখন ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থীরা দখলে নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নুরকে ভোট দিয়েছেন। এমন না যে ছাত্রলীগ ভোট দিয়ে নুরকে নির্বাচিত করেছে বা সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ সবাই ভিপি নুরকে ভোট দিয়েছে। তারা ছাত্রদলের মনোনীত প্রার্থীকে দেয়নি, এটাই সত্য। একসময়ের প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় ছাত্রসংগঠনের এতটা দুরবস্থা কেন? কেবলই ভোটে অনিয়ম বা সরকারের চাপ না। এর জন্য বিএনপিও সমানভাবে দায়ী।

বিএনপির আরেকটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, তাদের আমলে ঘটা ২১ আগস্টের ন্যক্কারজনক ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত না করা, বিচার তো পরের কথা। ক্ষমতায় থাকাকালে বরাবরই সাধারণ জনসাধারণের বিপক্ষে চলে যাওয়া তাদের আরেকটি প্রবণতা। ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর দুবার ক্ষমতায় এসে বিএনপি বেশ কয়েকটি ঘটনা সামাল দিতে পারেনি। প্রথমটি হচ্ছে দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যার বিচারের দাবিতে আন্দোলন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সারের দাবিতে কৃষকের বিক্ষোভ। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর ফুলবাড়ী কয়লাখনি আন্দোলন ও বিদ্যুতের দাবিতে কানসাট আন্দোলন হয়। এসব আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি চালিয়েছিল। এসব আন্দোলন তেমন জটিল কিছু ছিল না। কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে বিরোধী দলের ছায়া ও ষড়যন্ত্র খোঁজা সমীচীন না। এসব ক্ষেত্রে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কৌশলও অনুসরণ করতে পারছে না। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছিল। কিন্তু তিনি মনোযোগ সহকারে সেই বিক্ষুব্ধ ছাত্র ও শিক্ষকদের কথা শুনেছিলেন।

ক্ষমতা ছাড়ার পরও বিএনপি জনদাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে মিনমিন করে। ফুলবাড়ী কয়লাখনির রাজনীতি থেকে বিএনপির বোঝা উচিত ছিল, কীভাবে জনপ্রিয় ইস্যু নিজেদের দখলে আনতে হয়। জনগণের দাবির সঙ্গে শামিল হতে হয়। বিএনপি দলীয়ভাবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে খোলামেলাভাবে কিছু বলে না। মনে হচ্ছে বিএনপি কারও বিরাগভাজন হতে চায় না।

বিএনপি ক্ষমতার রোমান্টিক স্বপ্নে বিভোর। নির্বাচন হলেই ক্ষমতায় যাবে—স্বপ্নের এ আবেশ থেকে বেরিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিএনপিকে ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। বিএনপি যদি পুরোদমে রাজনীতিতে ফিরতে চায়, তবে দলের যথাযথ সংস্কার করে, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে, তাদের ওপর ভর করেই ফিরতে হবে। শুধু নীরব সমর্থনে কাজ হবে না। আর যদি জনগণ সাড়া না দেয়, তবে কোনো কিছুই বিএনপিকে রাজনীতির কক্ষপথে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। এখন বিএনপিকেই ঠিক করতে হবে তারা কী চায়।

ড. মারুফ মল্লিক: জার্মানিপ্রবাসী গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক