পথের দাবি, পথচারীর দাবি

ভাঙা পথের রাঙা ধুলা, হরেক যানের গগনবিদারী হর্ন, খানাখন্দের নোংরা পানির ছিটা—এসব নিয়েই ঢাকার রাস্তায় পথচারীদের ‘দীর্ঘজীবী নিত্য অভিসার’। এর বাইরে আছে আপৎকালীন প্রাকৃতিক প্রয়োজনকালীন শৌচাগারের সংকট। সব মিলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ঢাকার পথে নামলে পথচারীকে যে অবস্থায় পড়তে হয়, তাকে শোচনীয় বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না।

ঢাকা শহরে এমন কিছু জনস্থান আছে, যেগুলোকে কখনো হয়তো রাস্তা বলা যেত, এখন স্বচ্ছন্দে খানাখন্দ, ডোবা বা খাল আখ্যা দেওয়া যায়। এই শহরে সন্তর্পণে পা ফেলে হাঁটার মতো এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোকে কবি-কথাশিল্পীর বিশেষ কষ্টকল্পনার প্রয়োগ ছাড়া ফুটপাত বলে চালানো অতি দুরূহ। আপৎকালীন প্রাকৃতিক প্রয়োজন দেখা দিলে পথচারীরা কোথাও কোথাও কিছু কুঠুরির সন্ধান পেলেও পেতে পারেন, যেগুলোকে সিটি করপোরেশন গণশৌচাগার বলে দাবি করে থাকে, যে দাবিকে বিশেষত শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের পক্ষে ব্যবহার অনুপযোগিতার নিরিখে ন্যায্যতা দেওয়া কঠিন। শারীরিকভাবে সুস্থ পথচারীর কাছেই যেখানে এই পায়ে চলার পথ ও গণশৌচাগার ব্যবহার সহজসাধ্য নয়, সেখানে প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগিতার কথা লেখাই বাহুল্য।

নিত্য কলরবময় এই শহরে শব্দদূষণও যে নাগরিকের অসুবিধার কারণ হতে পারে, তা অধিকাংশ মানুষ অনুধাবনই করতে পারে না। এখানে রাস্তায় গগনবিদারী হর্ন, বিনোদন জলসার গান এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বক্তৃতা মাইকে বহুবর্ধিত হয়ে প্রত্যেকের ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিবার’ প্রয়াস চালায়। ঠাস বুনটের যাত্রীবাহী বাসে পার্শ্ববর্তী যাত্রীর অসুবিধার বিষয় সম্পূর্ণত উপেক্ষাপূর্বক মুঠোফোনে উচ্চ নিনাদে কথোপকথন এখানে নিত্য চর্চিত সহবত।

কোনো সভ্য দেশেই এই নগরজীবনকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয় না। সভ্য দেশে এ ধরনের রাস্তায় যাতায়াত করে বা যথার্থ শৌচাগারহীনতায় শারীরিক ক্ষতি ও মানসিক বিড়ম্বনার শিকার হলে ক্ষতিগ্রস্ত পথচারীকে সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকে। তবে ঢাকা শহরে সরকারি পরিষেবার ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে ধরে নিয়েই নাগরিকেরা পথে নামেন।

এই ব্যবস্থা মেনে নিয়ে কেউ বলতেই পারেন, অটোরিকশা বা রিকশার মতো যান-মাধ্যমে এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে নাচতে নাচতে গন্তব্য অভিমুখী যাত্রীদের কিছু বাধ্যতামূলক ব্যায়ামও হয়ে যায়, তাতে তাঁদের শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকে। সেই দিক থেকে সিটি করপোরেশন ফিজিওথেরাপির উপযোগী পথ উপহার দিয়ে তাঁদের উপকারই করছে। এর জন্য পথচারী ও যান-সওয়ারদের যৎপরোনাস্তি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

এবড়োখেবড়ো রাস্তা ও ফুটপাত না হয় মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু দেড় কোটি মানুষের ঢাকা শহরে মাত্র ৬২টি গণশৌচাগার থাকাকে গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করা যাবে কোন বিবেচনায়? আরও ভয়ানক খবর হলো, গণশৌচাগারের ৯০ ভাগের বেশিই প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। শৌচাগার তৈরির সময় প্রতিবন্ধীদের কথা বিবেচনা করে নকশা করা যে দরকার, তা এত দিন কারও মাথায়ই ছিল না। আশার কথা, সিটি করপোরেশন এখন প্রতিবন্ধীদের কথা মাথায় রেখে শৌচাগার তৈরি করছে।

সামনেই দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। প্রার্থীরা নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তাঁদের কাছে নগরবাসীর প্রত্যাশা খুব বেশি, এমনটা প্রতিভাত হয় না। তবে দুই নগরপিতা যদি পথচারীর নির্বিঘ্ন হণ্টন, উচ্চ শব্দের অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি ও প্রতিবন্ধীবান্ধব শৌচাগারের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে পারেন, সেটি ঢাকার বসবাসযোগ্যতাকে অনেকখানি এগিয়ে নিতে পারবে।