ভোট যেমন-তেমন, পরিবেশের বারোটা

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রচারপত্র, উন্মুক্ত চিঠি, কাগজ ও প্লাস্টিকের পোস্টার, ব্যানার ইত্যাদিতে ঢেকে গেছে ঢাকা। মাইকের উচ্চ শব্দে চারিদিক প্রকম্পিত! কানের পর্দা ফাটানো নির্বাচনী প্রচারণার শব্দ এখন ঢাকা শহরের যেকোনো এলাকাতেই শোনা যাচ্ছে। বিধি লঙ্ঘন করে রাত আটটার পর মিছিলের উচ্চ শব্দে একসঙ্গে মোটরসাইকেলের হর্ন বাজিয়ে, মাইকে জোরে চিৎকার করে স্লোগান ও গান বাজিয়ে প্রচারণা চলছে বিভিন্ন পাড়ায়। প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো পোস্টারে ছেয়ে রয়েছে ঢাকা। এই পোস্টার যেখানে সেখানে ঝরে গিয়ে পরিবেশও দূষণ করছে। প্রচারণার সময় কর্মীরাও রাস্তাঘাটে আবর্জনা ফেলে যাচ্ছেন।

উৎসবমুখর পরিবেশের কথা বলা হলেও নির্বাচনী প্রচারণার কাণ্ডজ্ঞানহীন পদ্ধতিতে ভয়াবহ পরিবেশদূষণের বহু উপকরণ রয়েছে। পরিবেশদূষণের ন্যূনতম কোনো উপলব্ধি আমাদের নির্বাচন কমিশন ও রাজনীতিবিদদের আদৌ আছে কি না, তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহের অবকাশ আছে। মাঠপর্যায়ের নির্বাচনী প্রচারণার প্রক্রিয়ায় দেখা যায়, বৈধ-অবৈধ উপায়ে অর্জিত অঢেল অর্থে চলে নির্বাচনী প্রচারণার ডামাডোল। রাজনীতি ও নির্বাচন যে অর্থ লগ্নি করা এবং নির্বাচনী বিনিয়োগ তুলে আনার ব্যবসা, তা এই অসুস্থ প্রচারণা দেখলে বুঝতে কষ্ট হয় না কারও। প্রার্থীর পোস্টার বানানোর দায়িত্বে সমন্বয়কারী থাকুন বা না-থাকুন, ওয়ার্ডের নেতা-কর্মীরা ভবিষ্যৎ আয়ের পথ উন্মুক্ত রাখতে নিজেরাই প্রচারপত্র, উন্মুক্ত চিঠি, কাগজ ও প্লাস্টিকের পোস্টার, ব্যানার ইত্যাদি তৈরিতে বিনিয়োগ করেন।
এই অর্থের উৎস অবৈধ কি না, চাঁদাবাজি কি না, তা মনে হয় আর ধর্তব্য বিষয় না। পরিবেশদূষণ ও চাঁদাবাজির বাইরেও এখানে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে প্রোপাগান্ডা। অর্থাৎ প্রচারপত্র, পোস্টার কিংবা ব্যানারে উল্লিখিত তথ্যের সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে একদিকে যেমন পরিবেশদূষণ হচ্ছে, অন্যদিকে মানুষকেও দেওয়া হচ্ছে বড় বড় ধোঁকা। সর্বশেষ সমস্যাটি হচ্ছে প্রচারপত্র, উন্মুক্ত চিঠি, কাগজ ও প্লাস্টিকের পোস্টার, ব্যানার ইত্যাদির কাণ্ডজ্ঞানহীন সংখ্যা। দেয়ালজুড়ে লাখে লাখে পোস্টার, রাস্তাজুড়ে হাজারে হাজারে ব্যানারকেন্দ্রিক শো-ডাউন যে নগরের শ্রীহানি করছে, এই বোধের অনুপস্থিতিও একধরনের অসভ্যতা। এই নির্বোধ অসভ্যতার লাগাম টানবে কে?

যেকোনো নির্বাচনী পত্র, পরিচয়পত্র, পোস্টার, ব্যানারে প্রদত্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনের দ্বারা যাচাই-বাছাই এবং অনুমোদিত হওয়ার দাবি রাখে। এর মাধ্যমে অসত্য তথ্য প্রবাহে একটা নিয়ন্ত্রণ আসবে। প্রার্থীর পরিচিতিমূলক একটা বাধ্যতামূলক বিলিপত্র থাকবে, যা নির্বাচন কমিশন তৈরি করে দেবে। এখানে নির্বাচনী হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যকে শ্রেণিবিন্যস্ত করে উপস্থাপন করা হবে, যাতে প্রার্থীর পেশাগত পরিচয়, শিক্ষাগতযোগ্যতা, পূর্ববর্তী সময়ের নির্বাচনী অঙ্গীকার, সাবেক সময়ে একই প্রার্থীর নির্বাচনী অঙ্গীকার ভঙ্গ, দেওয়ানি ও ফৌজদারি অপরাধে মামলা ও সাজার তথ্য, আয়কর ও সম্পদ সারাংশ, ব্যাংক ঋণ তফসিলীকরণ এবং ঋণ খেলাপ থাকা না-থাকার বিষয়াদি সঠিকভাবে উল্লিখিত থাকবে। একইভাবে পত্রিকায় দেওয়া বিজ্ঞাপনের তথ্যও যাচাই-বাছাইয়ের আওতায় আনতে হবে।

নির্বাচনী পত্র, পরিচয়পত্র, পোস্টার, ব্যানার ইত্যাদি ওয়ার্ডের জনসংখ্যা ভিত্তিতে মাথাপিছু হিসেবে তৈরি করার বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় ১০০ বা ২০০ মিটার অন্তর অন্তর নির্বাচন কমিশনের অনুমোদিত বিলবোর্ড বা ওয়াল থাকবে, যাতে প্রার্থীরা সুনির্দিষ্টসংখ্যক (একটি বা সর্বোচ্চ দুটি করে) পোস্টার সাঁটাতে পারবেন, যেগুলোর প্রকাশিত তথ্যও যাচাই-বাছাই হতে হবে। এই বিলবোর্ডের বাইরে কোথাও পোস্টার লাগানো যাবে না। প্রতি ১০০ মিটার পরপর তথ্য অনুমোদিত ব্যানার লাগানো যাবে, তবে নির্বাচনের ঠিক পরপর সেগুলো সরানো এবং রিসাইকেলের খরচ আগেই বন্দোবস্ত করা থাকবে।
নির্বাচনে মাইকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ চাই আমরা। বাচ্চাদের ঘুম এবং লেখাপড়ার বিষয় মাথায় রেখে সন্ধ্যা সাতটার পরে কোনো ধরনের শব্দদূষণ করার আয়োজন করা উচিত নয় বলে মনে করি। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট দূরত্বে অনুমোদিত দেয়ালচিকার ব্যাপারেও প্রার্থী ও মালিকপক্ষের মধ্যে একটা চুক্তির সূচনা করে দিতে হবে। এখানে নাগরের সৌন্দর্য রক্ষার বিষয় প্রাধান্য পাবে, জনস্বাস্থ্য-সম্পর্কিত বিষয়াদি আমলে নেওয়া হবে, সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ও।

নির্বাচনী পোস্টারের কাগজ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে তৈরি করার বাধ্যবাধকতায় আনতে হবে। এই পোস্টারে পরিবেশ-অবান্ধব কালি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এসব পোস্টার বৃষ্টির সঙ্গে রাস্তাঘাট ও ড্রেন হয়ে জলাশয়ে গিয়ে পড়ে। তাই নির্বাচনের সময় এবং পরে এসব পোস্টার কীভাবে রিসাইকেলে আসে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। নির্বাচনের পর প্রার্থীরা ব্যানার সরান না, এটা একটা অপসংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। এটা ব্যক্তি প্রার্থীর ওপর ছেড়ে না দিয়ে রিসাইকেল কোম্পানির দায়িত্বে আনা যায়, যেখানে প্রার্থী নির্বাচনী কাগজ, কাপড় ও প্লাস্টিক বর্জ্যের সংগ্রহ এবং রিসাইকেল খরচ বহনে বাধ্য থাকবেন। প্রতীক পাওয়ার আগেই এই আর্থিক চুক্তিগুলো সম্পাদন করতে হবে।
এলাকাভিত্তিক সংখ্যায় অনুমোদিত ব্যানার, পোস্টার উৎপাদনের সঠিক সংখ্যার বিপরীতে রিসাইকেল সেন্টারে জমাদানের হেরফের হলে প্রতি ব্যানারের বিপরীতে উচ্চ আর্থিক জরিমানা গুনবেন প্রার্থী। নির্বাচনী দূষণে জড়িত প্রার্থীকে পরবর্তী নির্বাচনে অযোগ্য করার কঠিন উদাহরণ সৃষ্টি করলে নির্বাচনী বর্জ্যের বিস্তার কমে আসতে পারে। এই বছর কাগজের পোস্টার ও প্রচারপত্রের বদলে প্লাস্টিকের পোস্টার লাগানো হচ্ছে। রিসাইকেল নিশ্চিত করা গেলেই শুধু প্লাস্টিকের পোস্টারকে উৎসাহ দেওয়া যায়।

নির্বাচনী প্রচারণা পরিবেশবান্ধব করার দায়িত্ব প্রার্থী ও নির্বাচন কমিশন উভয়ের। তবে পরিবেশ-অবান্ধব প্রচারণা বন্ধ করার ও নির্বাচনী বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পেশাদার দায়িত্ব অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের। পরিবেশ রক্ষার বোধ নির্বাচন কমিশনে অতি দ্রুত তৈরি হবে বলে আমরা আশা করতে পারি কি?

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব: প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।