লিবিয়া পরিস্থিতি: অশান্ত দেশটিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ বাড়ছে

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

২০১১ সালে লিবিয়ায় বিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ক্রমেই বাড়তে শুরু করেছে। যদিও কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্র সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছুটা পিছু হটেছে। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), ফ্রান্স, তুরস্ক, রাশিয়া এবং মিসরের মতো দেশগুলোর হস্তক্ষেপ ক্রমেই বাড়ছে। এরা সবাই গাদ্দাফি-পরবর্তী যুগে তাদের নিজস্ব স্বার্থ সুরক্ষিত করার চেষ্টা করছে।

২০১৫ সালে গঠিত লিবিয়ার জাতিসংঘ-সমর্থিত ত্রিপোলিভিত্তিক সরকার (জিএনএ) দেশটিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। যদিও এটিই একমাত্র পরিচালনা পর্ষদ, যা জাতিসংঘ দ্বারা স্বীকৃত, কিন্তু বিদেশি হস্তক্ষেপের কারণে এর স্বকীয়তা অনেকখানি ক্ষুণ্ন হয়েছে। জিএনএকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করেছে, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর প্রধান সমর্থক হলো ইতালি, তুরস্ক ও কাতার।

সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ফ্রান্স ও রাশিয়ার কিছু অংশ দলত্যাগী সেনা কমান্ডার খলিফা হাফতারকে সমর্থন করে আসছে, যিনি ২০১৪ সালের পর থেকে সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে লিবিয়ার ক্ষমতা নেওয়ার চেষ্টা করছেন। রাজধানী ত্রিপোলি দখল করতে তিনি ২০১৯ সালের এপ্রিলে সামরিক অভিযান শুরু করেন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এর ফলে সেখানে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ আরও বেড়েছে।

যদিও হাফতার দ্রুত লিবিয়ার রাজধানীর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন, কিন্তু তিনি তা করতে ব্যর্থ হন। এ কারণে তিনি তাঁর মিত্রদের কাছ থেকে আরও বেশি সমর্থন চাইতে বাধ্য হন। গত বছর হাফতার মস্কো সফর করার পর কয়েক শ ভাড়াটে রুশ সেনা পাঠানো হয়েছিল তাঁকে সাহায্য করার জন্য। এই ভাড়াটে সেনাদের বেশির ভাগ বেসরকারি সামরিক সংস্থা ওয়াগনার গ্রুপের সদস্য। গত কয়েক মাসে তাঁদের সংখ্যা বেড়ে ১ হাজার ৫০০ জনে দাঁড়িয়েছে।

এই মাসের শুরুতে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন স্বীকার করেছেন যে লিবিয়ায় রুশ যোদ্ধা রয়েছে। তবে তিনি দাবি করেন, এসব সেনা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে না এবং রুশ সরকার তাঁদের বেতন দেয় না। এদিকে ত্রিপোলিতে একটি আক্রমণাত্মক পরিস্থিতিতে, জিএনএ তার সমর্থকদের সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেছিল। তখন তুরস্ক সাড়া দেয়। গত নভেম্বরে লিবিয়া ও তুরস্কের মধ্যে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, যাতে উভয় দেশের মধ্যে সমুদ্র ও সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ‘বৈধ সরকারকে সমর্থন এবং একটি মানবিক ট্র্যাজেডি এড়াতে’ লিবিয়ায় সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দেন।

তুরস্কের লিবিয়ায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করার বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনকে সন্তুষ্ট বলে মনে হচ্ছে। আর এ কারণেই হয়তো যুক্তরাষ্ট্র লিবিয়ার ব্যাপারে খুব একটা নাক গলাচ্ছে না। ওয়াশিংটন ত্রিপোলিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে লিবিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ সীমিত রেখেছে। লিবিয়ার প্রতিবেশী দেশ আলজেরিয়াও জিএনএ সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। দেশটির সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লিবিয়ার দ্বন্দ্ব নিরসনে জড়িত হওয়ার বিষয়ে সোচ্চার হয়ে বলেছেন, জিএনএ বৈধ সরকার এবং ত্রিপোলি একটি লাল রেখা।

লিবিয়ায় ইউরোপের প্রধান খেলোয়াড় ইতালি ও ফ্রান্সকে গত বছর লিবিয়া থেকে পশ্চাদপসরণ করতে হয়েছিল। হাফতার ও জিএনএ-এর প্রধান ফয়েজ আল-সাররাজের মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার পর ইতালি লিবিয়ায় তার গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাব অনেকখানি হারিয়ে ফেলে। ৭ জানুয়ারি ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্তে রোমে হাফতার ও আল-সাররাজের মধ্যে একটি আকস্মিক বৈঠকের আয়োজন করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আল-সাররাজ কোনো ধরনের বৈঠক করতে অস্বীকৃতি জানান।

বর্তমানে তুরস্ক ও রাশিয়া লিবিয়ার দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য একসঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, তারা লিবিয়ার দুই মূল আন্তর্জাতিক খেলোয়াড় হয়ে উঠেছে। এই দুটি দেশ জিএনএ ও হাফতার বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে সক্ষম হয়েছে, যা ১২ জানুয়ারি কার্যকর হয়। এর পরদিন, আল-সাররাজ ও হাফতার মস্কোতে একটি আনুষ্ঠানিক শর্তহীন যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য বৈঠক করেন। পরে অবশ্য হাফতার আলোচনা থেকে সরে আসেন।

এই অনিশ্চয়তা ও ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে ১৯ জানুয়ারি জার্মানির বার্লিনে লিবিয়ার শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে লিবিয়ার যুদ্ধরত দুই পক্ষের পাশাপাশি তুরস্ক, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা অংশ নেন। এই সম্মেলনে বিশ্বনেতারা যুদ্ধবিরতি কার্যকর করায় লিবিয়াকে আর কোনো সামরিক সহায়তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিশ্বনেতাদের এই সিদ্ধান্ত লিবিয়ায় শান্তি আনতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
গুমা এল-গামাতি: লিবিয়ার শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ