দুটি মামলার রায়

দীর্ঘ সময়ের পরে দুটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের রায় আসার খবর নিশ্চয় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথে একটি অগ্রগতি। চট্টগ্রামের লালদীঘিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে তৎকালীন স্বৈরচারী এরশাদ সরকারের পুলিশ জনসভায় গুলি চালিয়েছিল। সেটা ছিল ১৯৮৮ সাল। এর ১৩ বছর পর ঢাকার পল্টনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা হলো আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬–২০০১) শেষ বছরে। দুই ঘটনার মধ্যে মিল হলো, চট্টগ্রাম হত্যাকাণ্ডের বছর তিনেকের মাথায় এবং সিপিবির সমাবেশে বোমা হামলার ১০ মাসের মধ্যে বিএনপি ক্ষমতাসীন হয়েছিল।

বিএনপি (১৯৯১–৯৬ এবং ২০০১–০৬ সালে ক্ষমতাসীন ছিল) ক্ষমতাসীন হয়ে উভয় মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতার নীতি অনুসরণ করেছিল। আর এই দুর্ভাগ্যজনক দীর্ঘসূত্রতার কারণেই হয়তো জাতীয় রাজনীতিতে অধিকতর গভীর ক্ষত সৃষ্টির পথ তৈরি হয়েছে। সিপিবি সমাবেশে হামলার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ঘটেছিল একুশে আগস্টের বিভীষিকা। এর এক বছর পরে দেশব্যাপী বোমা ফাটায় জঙ্গিরা, আর এক যুগের কম সময়ের মধ্যে ঘটে হোলি আর্টিজান বেকারি হামলা।

এটা বিশ্বাস করার তাই কারণ আছে যে, লালদীঘি হত্যাযজ্ঞের মতো ঘটনার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করা গেলে হয়তো প্রশাসনের ভেতরে আমরা বিচারবহির্ভূত হত্যা যন্ত্রের দানব সামাল দিতে পারতাম। পল্টনে সিপিবির সমাবেশে হামলার বিচার যথাসময়ে হলে বা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তখন তৎপর হলে হয়তো একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা বা হোলি আর্টিজানের মতো নারকীয় হামলাগুলো এড়ানো যেত। এর কুশীলবেরা হয়তো সংযত হতে বাধ্য হতো। কিন্তু এসব গুরুত্বপূর্ণ মামলার সুষ্ঠু তদন্ত বা বিচার আটকে থাকা প্রকারান্তরে অন্ধকারের শক্তিসমূহকে অপরাধ সংঘটনে আরও উৎসাহিত করেছে।

আমরা হতাশার সঙ্গে স্মরণ করতে পারি যে, ১৯৯০ সালে এরশাদের পতনের পর গণতন্ত্রের ‘নবযাত্রায়’ বিএনপি এসবের প্রতি গুরুত্ব দেয়নি। সুতরাং দুটি হামলার রায় প্রকৃতপক্ষে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একটি আত্মজিজ্ঞাসারও সুযোগ বয়ে এনেছে। বিএনপি যদি ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, ১৯৮৮ সালের চট্টগ্রামের গণহত্যা বা ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচার নিশ্চিত করতে পারত, তাহলে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ভিন্ন হতে পারত। এসব রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচারে কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বরং তারা বা তাদের মিত্ররা আত্মঘাতী তৎপরতায় লিপ্ত থেকেছে। যেমন ২০০১ সালে তারা বলেছে, এটা সিপিবির অভ্যন্তরীণ কোন্দল। ২০০৪ সালে ২১ আগস্টের ঘটনার পর বলেছে, এটা আওয়ামী লীগের ভেতর থেকে করা নাশকতা।

সার্বিক বিচারে চট্টগ্রাম গণহত্যার তিন দশক এবং পল্টন হামলার ১৯ বছর পরে হলেও রায় পাওয়াটা স্বস্তির। পল্টনে সিপিবির সমাবেশে হামলায় ১০ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড হওয়া বোধগম্য। কিন্তু জ্বলন্ত প্রশ্ন হচ্ছে, জনসভায় নির্বিচার গুলি চালানোর মতো দুষ্কর্ম কি কেবলই পুলিশের কাজ ছিল? এর মূল রাজনৈতিক দায় পতিত স্বৈরশাসক এরশাদ ও তাঁর দল কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে, যে স্বৈরাচারী রাজনৈতিক শক্তি সেদিনের ‘হুকুমের আসামি’ ছিল, যাদের নির্দেশে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে, তারাই এখন হত্যাযজ্ঞের শিকার রাজনৈতিক দলের ‘উন্নয়নের সহযোগী’। এটা পরিহাস যে, মিত্র বলেই যেন সব দায়মুক্তি নিয়ে তারা রাজনীতিতে দোর্দণ্ড প্রতাপে টিকে আছে। লালদীঘির জনসভায় গুলি চালিয়ে সরকার বিরোধীদের কণ্ঠরোধের উত্তরাধিকার আমরা নানাভাবে বয়ে চলছি কি না, সেই প্রশ্ন অবান্তর নয়।

নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার রায়ের মতো চট্টগ্রামে জনসভায় গুলি চালিয়ে আওয়ামী লীগের ২৪ নেতা-কর্মী হত্যায় পাঁচ পুলিশের ফাঁসি দৃষ্টান্ত তৈরি করল। প্রমাণিত হলো, আইনের চোখে যা অপরাধ, তা যেই করুক, চূড়ান্ত বিচারে পার পাওয়া কঠিন। এ থেকে সংশ্লিষ্টরা আশা করি শিক্ষা নেবেন।

সংশোধন: বুধবার ‘দুটি মামলার রায়: হত্যাযজ্ঞের দায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে বিএনপি-জামায়াত আমলে পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির( সিপিবি) সমাবেশে বোমা হামলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে হামলাটি হয়েছে আওয়ামী লীগ শাসনামলের (১৯৯৬–২০০১) শেষ দিকে ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত। বি.স.