দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো

সুলতানা কামাল। ফাইল ছবি
সুলতানা কামাল। ফাইল ছবি

দেখতে দেখতে ৭০ বছর পূর্ণ করে ফেললেন আমাদের বন্ধু সুলতানা কামাল, একসঙ্গে পথচলা ৫০ বছরের বেশি, চলার পথে অনেক বিস্ময় তিনি আমাদের জন্য তৈরি করেছেন। তাঁর কাছ থেকে যা ছিল প্রত্যাশা, তিনি সেটা বারবার ভেঙে দিয়েছেন নানাভাবে, দেশের মানুষের কাছ থেকে যে সম্মান, সম্ভ্রম ও ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, তা আমাদের গর্বিত করে, সেই সঙ্গে দেখি তাঁর বিবর্তন ও বিকাশ। নিজেকে তিনি ক্রমাগত যেভাবে ছাপিয়ে চলেছেন, তা অবাক করার বিষয় বটে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে সুলতানা কামাল পড়েছেন ইংরেজি বিভাগে, এই বিভাগ থেকে সেরা ছাত্ররা তখন যোগ দিত পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে, ছাত্রীরা সমাজের ওপর মহলে পেত বিশেষ আসন। বিভাগের আভিজাত্যই ছিল আলাদা, কিন্তু সুলতানা কামাল সেই গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি। নিজ বিভাগ ছাপিয়ে নানা কাজে, নানা উদ্যোগে নিজেকে যুক্ত করেছেন তিনি। সংস্কৃতি সংসদের কাজে তাঁর ছিল উত্সাহী ভূমিকা, সত্তরের ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় পরিচালিত ত্রাণকাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ, আর গণ-আন্দোলনেও তাঁকে দেখা গেল সামনের কাতারে। 

একাত্তরের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনায় যে চার তরুণী বহন করেছিলেন স্বা-ধী-ন-তা লেখা প্ল্যাকার্ড, তাঁদের একজন তো সুলতানা কামাল, যে ছবি ইতিহাসের অংশী হয়ে আছে। সক্রিয়তা ও সম্পৃক্ততা তাঁর ক্রমেই বেড়ে চলেছিল, তাই তো মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই বোন সুলতানা ও সাঈদা কামাল সীমান্ত পেরিয়ে যোগ দেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচর্যার ফিল্ড হাসপাতালে, বিশ্রামগঞ্জে, সেটাও তো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। 

স্বাধীন বাংলাদেশে নাটকের যে নবযাত্রা শুরু হলো, সেখানেও দেখি সুলতানা কামালকে, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের হয়ে মঞ্চে নেমেছেন তিনি। তার আগে অক্টোবরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে নিবেদিত নাটকে তাঁকে দেখা যায় অভিনেত্রীর ভূমিকায়। জীবনমঞ্চেও বহু চরিত্র তাঁর সামনে মেলা ছিল, কিন্তু আকর্ষণীয় ও উজ্জ্বল সেসব ভূমিকা তুচ্ছ করে সুলতানা কামাল বেছে নিলেন ভিন্ন এক পথ, যে পথে কোনো আকর্ষণ নেই, আছে কঠোর কঠিন সাধনা। 

শিক্ষাজীবন শেষে একপর্যায়ে সুলতানা কামাল সদ্য প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাকের হয়ে কাজ করতে চলে যান দূর সুনামগঞ্জে। আমরা কেউ যখন শহর ছাড়ার কথা কল্পনাও করতে পারিনি, তখন কোন তাড়নায় তিনি চলে গেলেন গ্রামে, তা বুঝতে পারিনি। চিরকাল শহরবাসী অভিজাত পরিবারের তরুণীর জন্য এ ছিল গণ্ডিভাঙা অভিযান।

একপর্যায়ে সেখানে সুপ্রিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে ভালোবাসা ও বিয়ে, সিলেটে স্থিতি, সবই ছিল অবাক করা। পরে যখন সুপ্রিয়দার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ও সখ্য ঘটে, তখন বুঝি কী অসাধারণ মাধুর্যময় ব্যক্তিসত্তা তাঁর, কোন গুণে জয় করে নিয়েছেন আমাদের মধ্যকার চৌকস ছাত্রীটিকে। ইতিমধ্যে ইংরেজির পাঠ শেষে সুলতানা কামাল ডিগ্রি নিয়েছেন আইনের, সেটাও প্রচলভাঙা এবং প্র্যাকটিস শুরু করেছেন সিলেট আদালতে। যাঁর সামনে বিকাশের বহু পথ খোলা ছিল, তাঁর জন্য অভাবনীয় এই ভূমিকা।

অজান্তেই সুলতানা কামাল এভাবে আমাদের প্রত্যাশার বাইরে অন্য এক ব্যক্তিত্ব নিয়ে নিজেকে গড়ে তুললেন, সুফিয়া কামালের কন্যা বটে, তবে স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল ব্যক্তিসত্তা। সিলেটে এই দম্পতি হয়ে উঠেছিলেন শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র, উদারতাবাদের নির্ভর, মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। পরে ঢাকায় স্থিত সুলতানা কামাল নিজ গুণে ও কর্মে জাতীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। দেখতে দেখতে পরিণত হন নিপীড়িতের ভরসা এবং দুর্বিনীতের ত্রাসে। দেশজুড়ে চলে তাঁর বিচরণ, সমাজের দুর্বল অংশ, নারী কিংবা সংখ্যালঘু, তারা নির্যাতনে পাশে পায় সুলতানা কামালকে। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন অথবা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সুলতানা কামালের সম্পৃক্তি হয়ে ওঠে একান্ত স্বাভাবিক, যদিও কাজটি সহজ ছিল না। বাধাও তাঁকে মোকাবিলা করতে হয়েছে অনেক, কখনো কুৎসার শিকার, কখনোবা প্রত্যক্ষ হামলার হুমকি, কিন্তু সহজিয়া ধারায় সবকিছু উপেক্ষা করে চলেছে তাঁর কর্মসাধনা। মায়ের প্রতিচ্ছবি তাঁর মধ্যে মিলবে অনেকভাবে, তারপরও সুলতানা কামাল আপন মহিমায় ভাস্বর, স্বাতন্ত্র্য দীপ্যমান। 

বহু মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত তিনি, সব মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর অভিযাত্রার বিরাম নেই। ক্ষমতার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবহারের সুবর্ণ সব সুযোগ অগ্রাহ্য করে, সব প্রলোভনের হাতছানি উপেক্ষা করে, বাধাবিঘ্ন দুপায়ে দলে তাঁর অভিযাত্রা তাঁর একারই সংগ্রাম। আমরা কেবল জানাতে পারি শুভকামনা, আমাদের সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সন্তানের জন্য। 

নিশ্চিত জানি জন্মদিনের এমন শুভকামনার সঙ্গে যোগ রয়েছে অসংখ্য মানুষের, কেননা সংকটকালে তারা পাশে পায় সুলতানা কামালকে, সাহসী, স্পষ্ট বক্তা, দরদি ও কর্মী মানবীকে, যিনি দুর্বলের রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ও দুর্জনেরে হানতে দ্বিধাহীন। 

মফিদুল হক লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব