চীন মিয়ানমারকে চাপ দেবে না

প্রায় ২০ বছর পর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মিয়ানমারের দুদিনের (জানুয়ারি ১৬-১৮,২০২০) সফর শেষ করেছেন। দুই দিনের সফর সংক্ষিপ্ত হলেও দুই দেশের জন্যই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রায় দুই দশক চীনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কোনো নেতা মিয়ানমার সফর করেননি। সেদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, বিশেষ করে এমন এক সময়, যখন মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্যাপক চাপের মধ্যে পড়েছে। সি চিন পিং শুধু চীনেরই নন, বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে গণ্য। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী দেশ। বর্তমানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি আগের তুলনায় কিছুটা মন্থর হলেও উচ্চ অঙ্কের প্রবৃদ্ধির মধ্যেই রয়েছে। চীন বিগত প্রায় তিন দশক আফ্রো-এশিয়ার দেশগুলোতে যে ধরনের লগ্নি অব্যাহত রেখেছে, তাতে বিশ্বের যেকোনো দেশকে পেছনে ফেলেছে।

একক প্রকল্প হিসেবে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) সবচেয়ে বেশি অর্থ লগ্নি করা হয়েছে। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত এই প্রকল্পে ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লগ্নি করা হয়েছে। এই বিআরআই প্রকল্পের পূর্ব প্রান্তের প্রধান খুঁটি মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল। রাখাইন অঞ্চল ঘিরেই চীনের পূর্ব প্রান্তের অর্থনৈতিক করিডর তৈরি হচ্ছে। কাজেই সি চিন পিংয়ের মিয়ানমার সফর শুধু দুই দেশেরই নয়, বরং এ অঞ্চলের ভবিষ্যতের ভূ-কৌশলগত ও ভূ-রাজনীতির বিশাল পরিবর্তনের সূচনা করেছে। এই দ্রুত পরিবর্তিত ভূ-কৌশল ও ভূ-রাজনীতির নতুন মেরুকরণের কারণেই সি চিন পিংয়ের মিয়ানমার সফর ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। এই সফর শুধু আঞ্চলিক ভূ-কৌশলের পরিবর্তনের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। কারণ, এই সফরের সময়ে মিয়ানমার-চীনের আলোচনার মধ্যে স্থান পায় বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা বিষয়। এ কারণেই আমাদের জন্যও এ সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কের ৭০ বছরপূর্তিও উদ্‌যাপিত হয়েছে এ সফরের মাধ্যমে। সি চিন পিং তাঁর এ সফরের সময়ে মিয়ানমারের সরকারপ্রধান হিসেবে বিবেচিত অং সান সু চি এবং মিয়ানমারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সিনিয়র জেনারেল মিং হ্লাইংয়ের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠক ও আলোচনায় চীনের সঙ্গে রোহিঙ্গা বিষয়ে যেসব কথা হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, তাতে চীন রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে। শুধু মিয়ানমারের পাশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও চীন মিয়ানমারের পক্ষে থাকবে বলে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অঙ্গীকার করেছে।

অপর দিকে মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনায় মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই সহযোগিতার কথা বলেছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের পুরোনো ছকের কথা পুনরায় উল্লেখ করে বলেছে যে যারা বৈধ কাগজপত্র দেখাবে, শুধু তাদের মধ্য থেকেই বাছাই করে ফেরত নিতে প্রস্তুত। কাজেই মিয়ানমারের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। মিয়ানমার রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের যে ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না এবং সবাইকে ফেরত নেবে না, তেমন অবস্থানেই রয়েছে। গত ডিসেম্বরে আইসিজে শুনানিতে, যার অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ কাল ২৩ জানুয়ারি দেওয়ার কথা, তা নিয়ে মিয়ানমারের অং সান সু চিসহ শীর্ষ পর্যায়ের সামরিক ও বেসামরিক নেতাদের কোনো উদ্বেগ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

চীনের প্রেসিডেন্টের সফর এমন সময় সম্পন্ন হয়েছে, যখন রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ বিষয়ের কারণে শুধু আইসিজেতেই নয়, মিয়ানমার সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বের চাপের মুখে পড়েছে। এসব চাপের কারণে মিয়ানমারের অর্থনীতির ওপরে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তা ছাড়া, অং সান সু চির প্রতি মিয়ানমারের প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠী বৌদ্ধ ও উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সু চির অবস্থানকে আরও দৃঢ় করবে সি চিন পিংয়ের এই সফর।

সি চিন পিংয়ের এই সফরকে অনেক বিশেষজ্ঞ মিয়ানমারকে চীনের একধরনের ‘ব্ল্যাকমেল’ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এই সফরেই চীন ৩৩টি চুক্তি-সমঝোতা স্মারকসহ ১৩টি প্রটোকল সই করেছে। এসব চুক্তি ও সমঝোতার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে রাখাইন রাজ্যের সিতওয়ের দক্ষিণে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের সংযোগস্থলে কিকাপু বা কিচাপু গভীর সমুদ্রবন্দর এবং বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চল গঠনের চুক্তি। ইতিমধ্যেই রাখাইন থেকে গ্যাস ও তেলের পাইপলাইনের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের সোয়ে গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস এবং মধ্যপ্রাচ্যের তেল ইতিমধ্যেই চীনের পূর্বাঞ্চলে সঞ্চালিত হচ্ছে।

একই প্রকল্পের আওতায় ইয়াঙ্গুন বন্দর থেকে সিতওয়ে এবং পর্যায়ক্রমে মান্দালয় হয়ে চীনের পূর্বাঞ্চলের বন্দর পর্যন্ত বুলেট ট্রেন প্রকল্পের সমঝোতা হয়েছে। এককথায় এটাই চীনের মেগা প্রজেক্ট চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর (সিএমইসি)। স্মরণযোগ্য যে পাকিস্তানের গভীর সমুদ্রবন্দর গোয়াদের থেকে একই ধরনের অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) চীনের মধ্য এশিয়া অঞ্চলে যোগাযোগ স্থাপন করছে। প্রায় ৪৫ বিলিয়ন ডলারের এই সিইপি প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলেছে।

রাখাইনের এই গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার হাম্মানটোটা, মালদ্বীপের মালে এবং পাকিস্তানের গোয়াদরকে যোগ করে চীন ইন্দো-মার্কিন-জাপানের সম্মিলিত পরিকল্পিত ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। চীন রাখাইন অঞ্চলের গভীর সমুদ্র ও চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর স্থাপনের মাধ্যমে পশ্চিমা শক্তি ও জাপাননিয়ন্ত্রিত মালাক্কা প্রণালিকে পাশ কাটাতে পারবে। কাজেই রাখাইন অঞ্চলে ক্রমেই যেমন চীনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনি মিয়ানমার চীনের ওপর পুনরায় নির্ভরশীল হয়েছে। এই মুহূর্তে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া মিয়ানমারের অন্য পথ নেই। এ সুযোগ হাতছাড়া করবে না চীন, যার লক্ষ্যে এখনো রয়েছে মিয়ানমারে আরও কিছু মেগা প্রজেক্ট।

চীনের দৃষ্টি এখন দুই দশকের ওপরে আটকে থাকা অন্যতম বৃহৎ প্রকল্প মাইটসন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, যার প্রাক্কলিত ব্যয় প্রায় ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মিয়ানমারের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইরাবতী নদীতে পানি বহনকারী ন’মাই এবং মালি নদীর সংযোগস্থলের এই বাঁধ প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করবে, যার ৯০ শতাংশ চীনের ইউনানে রপ্তানি হবে। প্রকল্পটি ২০১৭ সালে স্থগিত করা হয়েছিল। মিয়ানমার বিশেষজ্ঞরা ধরে নিয়েছেন যে সি চিন পিংয়ের সফরের সময় স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পও রয়েছে। যদিও যৌথ বিবৃতি এবং অন্যান্য তথ্যে এই প্রকল্পের কোনো উল্লেখই নেই। কাচিন স্টেটের এই জায়গাতে একসময় কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মির (কিআইএ) প্রভাব ছিল। তবে কাচিন আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের যুদ্ধবিরতিতে চীন মধ্যস্থতা করেছে বলে বিশেষজ্ঞদের তরফে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এই সফরের মাধ্যমে সি চিন পিং এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির সুরাহা করতে সক্ষম হয়েছেন। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ও প্রায় পশ্চিমা লগ্নি-বিচ্ছিন্ন মিয়ানমারের সামনে এত বড় বিনিয়োগের বিকল্পও তেমন নেই। সি চিন পিংয়ের সফরের সময় অবশ্য কয়েক শ মানুষ মাইসিন প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিল। কিন্তু তারপরও এ প্রকল্প শিগগিরই পুনরায় সচল হবে বলে মনে হয়।

সি চিন পিংয়ের মিয়ানমার সফর একেবারেই নিখুঁত ছিল, তেমন বলাও যায় না। সিনিয়র জেনারেল ও সর্বাধিনায়ক হ্লাইংয়ের সঙ্গে আলোচনার একপর্যায়ে উত্তর-পূর্বের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি চীনের সশস্ত্র সহযোগিতার কথা উঠলে সি চিন পিং সরাসরি এমন অভিযোগ নাকচ করেন। তবে তিনি স্বীকার করেন যে এর সঙ্গে হয়তো ওই অঞ্চলের অস্ত্র চোরাকারবারি ও অবৈধ অস্ত্র প্রস্তুতকারীদের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। তিনি তা খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন। মিয়ানমারের প্রায় ৭০ বছরের অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জড়িত বিভিন্ন গোষ্ঠীকে চীনের কোনো না কোনো স্তর থেকে সহযোগিতারও অভিযোগ রয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট যখন নেপিডো সফর করছিলেন, তখনো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে উত্তর-পূর্বের চীন-মিয়ানমার সীমান্তে কোকাং ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মির সংঘর্ষ চলছিল। ভূ-কৌশলবিদেরা মনে করেন, চীন পরোক্ষভাবে মিয়ানমারকে চাপের মধ্যে রাখতে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে এ ধরনের সহযোগিতা বজায় রেখেছে। মিয়ানমারের প্রায় নিশ্চিহ্ন কমিউনিস্ট পার্টি এখনো চীনের কোনো না কোনো পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ৭০ বছরের সম্পর্ক কখনো উষ্ণতার আবার কখনো শীতলতার মধ্য দিয়ে গেলেও সম্পর্কটি নিরবচ্ছিন্নই থেকেছে। এখন মিয়ানমারের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু ও ত্রাণকর্তা হিসেবে পাশে রয়েছে চীন। শুধু বন্ধুত্বের কারণেই নয়, বর্তমান বিশ্বের ভূ-কৌশলগত প্রেক্ষাপট ও ভূ-কৌশলগত কারণে মিয়ানমার চীনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে প্রায় বর্তমানে সম্পাদিত চুক্তিগুলোর মধ্যে ১০ থেকে ১১ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প রয়েছে।

চীনের ভূ-রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং বিআরআই বাস্তবায়নে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেকোনো দেশের চেয়ে মিয়ানমার অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন মিয়ানমারের ছকের বাইরে যাবে, অথবা চীন মিয়ানমারকে ছকের বাইরে যেতে চাপ দেবে—এমন মনে হয় না। যদিও চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও গভীর। রোহিঙ্গা বিষয়টির সুষ্ঠু নিষ্পত্তি করতে হলে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে আর কঠিন চাপে রাখা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাংলাদেশের সামনে এই বিষয়ই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ
[email protected]