পিএইচডি: জালিয়াতি, তেজারতি ও মেহনতি

ড. আইনুন নিশাত একজন গুণী মানুষ। তিনি রসিকও বটে। বহু বছর আগে মজা করে তিনি আমাকে পিএইচডির গল্প বলেছিলেন। তাঁর মতে, পিএইচডি চার–পাঁচ ধরনের। তেজারতি পিএইচডি হচ্ছে যেটা টাকাপয়সা খরচ করলে পাওয়া যায়, খয়রাতি মানে যা অকাতরে বিনা যোগ্যতায় দেওয়া হয় আর জালিয়াতি মানে যা অন্যের লেখা চুরি করে পাওয়া যায়। এর মধ্যে একমাত্র খাঁটি হচ্ছে মেহনতি পিএইচডি, যা মেহনত বা কষ্ট করে পাওয়া যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেহনতি পিএইচডি বহু আছেন। আমার নিজের বিভাগের উদাহরণ দিই। আমাদের আইন বিভাগে বর্তমানে শিক্ষক আছেন ৪১ জন। এর মধ্যে পিএইচডি করেছেন ২৮ জন, করছেন আরও ৪ জন। এ ৩২ জনের মধ্যে মাত্র ৪ জন পিএইচডি করেছেন/করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বাকিদের প্রায় সবাই বিশ্বের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

অন্য অনেক বিভাগে একই ধরনের অবস্থা রয়েছে। তবে এটাও ঠিক যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিভাগে পিএইচডি নিয়ে প্রশ্ন আছে। এর মধ্যে সান্ধ্যশিক্ষা বাণিজ্যে ব্যাপকভাবে অভিযুক্ত কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। সেখানকার একজন শিক্ষকের পিএইচডি প্রদানের উদারতা পৌঁছেছে কিংবদন্তি পর্যায়ে। ধরা যাক তাঁর নাম মার্কোস। মার্কোসের অধীনে অনায়াসে পিএইচডি করেছেন অর্ধশতাধিক গবেষক! খয়রাতি পিএইচডি পাওয়া এঁদের বিশ্ববিদ্যালয়পাড়ায় তুচ্ছার্থে বলা হয়, সে তো মার্কোস পিএইচডি!

২.
খয়রাতি পিএইচডি দেওয়া হয় স্বার্থের বিনিময়ে (যেমন নির্বাচনে ভোট, শিক্ষক রাজনীতিতে অন্ধ সমর্থন বা অন্য কোনো সুবিধা প্রদান)। খয়রাতি পিএইচডি উদ্বেগজনক। তবে আরও অনেক বেশি উদ্বেগজনক যা, সেই জালিয়াতি পিএইচডিও আছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।

প্রথম আলোর গতকালের প্রতিবেদনে এমন একটি জালিয়াতি পিএইচডির খবর পাওয়া গেছে, যার ৯৮ শতাংশই নকল! এ পিএইচডি-টি সম্পন্ন করা হয়েছে মাত্র এক-দেড় বছরে! আমরা যারা ঘর-সংসার ফেলে দিনরাত গবেষণা করে ইংল্যান্ডে পিএইচডি করি, আমাদের সময় লাগে গড়ে প্রায় চার বছর। আমেরিকায় করলে লাগে পাঁচ-ছয় বছর। আর দেশে পুরোদমে গার্হস্থ্য জীবনযাপন করে তাঁর লেগেছে এক বছরের সামান্য কিছু বেশি সময়!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রকেটগতিতে সম্পন্ন করা এ রকম আরও কয়েক ডজন পিএইচডিধারী আছেন। ভালোমতো খতিয়ে দেখলে এসবের অনেকের মধ্যে জালিয়াতির আলামত পাওয়া যেতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পিএইচডি প্রসব করেন রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা। তাঁদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বেও থাকেন সাধারণত একই ধরনের শিক্ষক।


গবেষণাকর্মে জালিয়াতি সারা বিশ্বে একটি সমস্যা। তবে এটি উন্নত বিশ্বে হয় কালেভদ্রে। জালিয়াতি ধরার নানা প্রোগ্রাম এখন সহজলভ্য, ইন্টারনেটও সবার হাতের মুঠোয়। ফলে জালিয়াতি ধরতে চাইলে ধরাও কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।

সমস্যা হচ্ছে জালিযাতি ধরার দাঁয়িত্ব যাদের, তাঁরাই যখন এর সহযোগী হন বা সেই দায়িত্ব সম্পূর্ণ এড়িয়ে যান। ৯৮ শতাংশ জাল পিএইচডির ঘটনায় সুপারভাইজার এবং পরীক্ষকদের দায়িত্ব ছিল এ জালিয়াতি উদ্‌ঘাটনের। পিএইচডি গবেষণাটি রহস্যজনক দ্রুততায় সম্পন্ন হওয়ার পরও এর মৌলিকত্ব তাঁরা কেন পরীক্ষা করে দেখেননি তা তদন্ত করা প্রয়োজন।

জালিয়াতি পিএইচডি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশি গবেষকদের কাজ থেকে চুরি করে করা হয়। ফলে ধরা পড়লে তা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেজ ধসিয়ে ফেলে। এর শিকার হন বিদেশে পড়তে যেতে ইচ্ছুক বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী।

জালিয়াতি পিএইচডি গোটা শিক্ষকসমাজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কেও প্রশ্নের মুখে ফেলে। গুটিকয়েক শিক্ষকের অসততা অন্য শিক্ষকদের সম্পর্কে ঢালাও খারাপ ধারণা তৈরি করে দেয়। তরুণসমাজ হয় বিভ্রান্ত।


জালিয়াতি পিএইচডির চেয়েও খারাপ বিষয় হচ্ছে এ জালিয়াতির শাস্তিবিধান না করা। প্রকাশিত সংবাদের পরও গবেষণার জালিয়াতির জন্য শাস্তি হয় না—এ রকম উদাহরণ আমরা আগে দেখেছি। ক্ষুদ্র গোষ্ঠীস্বার্থে যাঁরা এমন উদাহরণ সৃষ্টি করেন, তাঁরাও জালিয়াতির সহগামী। তাঁদের কারণেই গবেষণাচর্চায় নতুন নতুন জালিয়াতির সাহস সৃষ্টি হয়।

৯৮ শতাংশ নকল পিএইচডির ভয়াবহ সংবাদের পরও এদের টনক একটুও নড়বে কি? আমি নিশ্চিত না।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক