চার শিক্ষার্থীকে নির্যাতন

ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের চার ছাত্রকে দীর্ঘ সময় ধরে ও দফায় দফায় নির্যাতনের পর হল প্রশাসনের মাধ্যমে পুলিশে দেওয়ার ঘটনা কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) সংঘটিত আবরার ফাহাদ হত্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। গত অক্টোবরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে একই কায়দায় নির্যাতনের শিকার হয়ে আরবার ফাহাদ নিহত হন।

ক্যাম্পাসে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা ও পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। জহুরুল হক হলের ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে, সেটি শুধু নিন্দনীয় নয়, অমার্জনীয়ও।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের অতিথিকক্ষে ‘গেস্টরুম কর্মসূচি’ শেষে রাত দুইটা পর্যন্ত ওই শিক্ষার্থীদের পেটান ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা-কর্মী। এই নির্যাতনের কাজে তাঁরা হাতুড়ি ও ডিশের তার ব্যবহার করেন। পরে হল প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের মাধ্যমে তাঁদের রাজধানীর শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বুধবার বেলা দেড়টার দিকে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ওই চার ছাত্র হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের সানওয়ার হোসেন, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মো. মুকিম চৌধুরী, একই বর্ষের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মিনহাজ উদ্দীন ও আরবি বিভাগের আফসার উদ্দীন।

ডাকসু ও ছাত্রসংগঠনগুলোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মভিত্তিক তথা শিবিরের রাজনীতি আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ। এখন এই চার ছাত্র যদি এমন কিছু করে থাকেন, যাতে ‘আইনভঙ্গের’ ঘটনা ঘটেছে, তাহলে তঁাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৬৭ জন শিক্ষার্থীকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে। উল্লিখিত চার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ বা আইনভঙ্গের প্রমাণ থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেত। সেটি না করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কার্যত ছাত্রলীগের সহযোগী হিসেবে নির্যাতনের শিকার ওই চার ছাত্রকে থানায় সোপর্দ করেছে। এর মাধ্যমে তারা আক্রমণকারী তথা ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সম্ভবত এই বোধবুদ্ধি হারিয়েছে যে কোনো অবস্থাতেই কাউকে নির্যাতন করার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা–ও হাস্যকর। ওই চার ছাত্রকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রশাসন থানায় না পাঠিয়ে যাঁরা তঁাদের ওপর হামলা করেছেন, তঁাদেরকেই আইনের আওতায় আনা উচিত ছিল। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই।

যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে আইনানুযায়ী। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে মনে হচ্ছে, সেখানে আইনকানুনের বালাই নেই। ছাত্রলীগের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই সব। ডাকসু নির্বাচনের সময় ছাত্রলীগসহ সব ছাত্রসংগঠনই গেস্টরুম সংস্কৃতির নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর জবরদস্তি বন্ধ করার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু নির্বাচনের ১১ মাস পরও গেস্টরুম সংস্কৃতি বহাল তবিয়তে আছে। ডাকসু ভিপির দাবি অনুযায়ী, জহুরুল হক হলে যে চার শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের মারধরের শিকার হয়েছেন, তার কারণ তঁারা শিবির করেন বলে নয়। ছাত্রলীগ নেতাদের ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁদের প্রটোকল না দেওয়ায় তঁারা ক্ষুব্ধ হয়ে মারধর করেছেন। কোনো সভ্য দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের জবরদস্তি চলতে পারে না।

জহুরুল হক হলে চার ছাত্রকে মারধর করার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি করেছে। আশা করি, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সত্য উদ্‌ঘাটন করা হবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্তের নামে অপরাধীদের আড়াল করা হলে তার পরিণাম কখনোই ভালো হতে পারে না।