নির্বাচনটি যেন প্রহসনে পরিণত না হয়

হাইকোর্টের নির্দেশের পরও লেমিনেটেড পোস্টার উচ্ছেদ হয়নি
হাইকোর্টের নির্দেশের পরও লেমিনেটেড পোস্টার উচ্ছেদ হয়নি

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাত্র ছয় দিন বাকি। ১ ফেব্রুয়ারি ভোট গ্রহণ। এখন পর্যন্ত বড় কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা প্রার্থী নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেননি। এ থেকে ধরে নেওয়া যায় যে তাঁরা ভোটার তথা নগরবাসীকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। হয়তো তাঁরা মনে করছেন, ভোটাররা কেন্দ্রে এলেও নির্বাচন হবে, না এলেও। ইশতেহারের কী প্রয়োজন? মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা জনসংযোগ করছেন। গ্রিন ঢাকা, ক্লিন ঢাকা, ঐতিহ্যের ঢাকা, গৌরবের ঢাকা গড়ার কথাও বলছেন। কিন্তু নাগরিক সমস্যাগুলো সমাধানের কোনো রূপরেখা কেউ দেননি।

সাধারণত দল বা প্রার্থীরা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার মাধ্যমে ভোটারদের কাছে অঙ্গীকার করেন। এটি একধরনের ওয়াদাপত্র। পরবর্তীকালে নির্বাচিত মেয়র বা কাউন্সিলর সেটি পূরণ না করলে ভোটাররা বলতে পারতেন, আপনি কথা দিয়ে কথা রাখেননি। একজন ওয়াদা ভঙ্গকারী।

গত কয়েক দিন ঢাকার কয়েকটি ওয়ার্ডে ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে তাঁদের উৎসাহ কম। অনেকের ধারণা, নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে না। মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন না। যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, সেই নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের উচ্ছ্বাস থাকার কারণ নেই। আবার কেউ কেউ ভাবেন, নির্বাচন হলেই বা কী না হলেই কী। নগরের সমস্যাগুলোর প্রতি কারও নজর নেই। প্রার্থীরা যতই অঙ্গীকার করুন না কেন নির্বাচনের পর ভুলে যাবেন। এসব কারণে নির্বাচনী প্রচারে মানুষের চেয়ে পোস্টারের সংখ্যা বেশি। হাইকোর্টের নির্দেশের পরও লেমিনেটেড পোস্টার উচ্ছেদ হয়নি। নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। নির্বাচনী প্রচারে কোনো প্রার্থীর পক্ষে জনসমাগম বেশি হলেই বলা যাবে না, তাঁর জনসমর্থন বেশি। আসলে ‘গণের’ সঙ্গে প্রার্থী ও দলের সম্পর্ক ক্রমেই আলগা হয়ে যাচ্ছে। মানুষের কাছে এখন প্রার্থী বড় নয়। ভোট দিতে পারা না পারার প্রশ্নটি বড় হয়ে উঠেছে। একসময়ের জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘আমার ভোট আমি দেব, দেখে শুনে বুঝে দেব’। এখন ভোটার কেন্দ্রে না গেলেও ভোট দেওয়া হয়ে যায়!

প্রচারের ধরন, নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি থেকে মনে হচ্ছে, এবার ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে জনগণের প্রাত্যহিক সমস্যার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যু। এক দল উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিচ্ছে। আরেক দল গণতন্ত্র উদ্ধারের কথা জোরেশোরে বলছে। নির্বাচন এলে চাওয়া–পাওয়ার একটা হিসাব হয়। আগের পাঁচ বছর নির্বাচিত মেয়র কিংবা কাউন্সিলর কী করেছেন, নির্বাচন সামনে রেখে ভোটাররা জানতে চাইবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের এখানে সেটি হোক জাতীয় কিংবা স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিতরা ভোটারদের কাছে কৈফিয়ত দিতে অভ্যস্ত নন। তাঁরা নিজেদের কোনো ব্যর্থতা দেখেন না।

২.

আগে জাতীয় বা স্থানীয় পর্যায়ের যেকোনো নির্বাচন এলে আলোচনার একটি অভিন্ন বিষয় থাকত। কেমন নির্বাচন চাই। কেমন সিটি মেয়র-কাউন্সিলর চাই। কেমন সাংসদ চাই। কেমন চেয়ারম্যান বা পৌর মেয়র চাই। হালে কেমন নির্বাচন চাই-এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে—কেমন নির্বাচন চাই না। কেমন মেয়র বা কাউন্সিলর চাই না। কেমন সাংসদ চাই না।

কেমন সিটি মেয়র বা কাউন্সিলর চাই না প্রশ্নের আংশিক উত্তর এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দিয়েছে। ২০১৫ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। দক্ষিণে সাঈদ খোকন ইলিশ প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন ৫ লাখ ৩৫ হাজার ২৯৬ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মির্জা আব্বাস মগ প্রতীক নিয়ে পেয়েছিলেন ২ লাখ ৯৪ হাজার ২৯১ ভোট। ঢাকা উত্তরে আনিসুল হক তুলনামূলক কম ভোটে জিতেছিলেন। তাঁর প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪ লাখ ৬০ হাজার ১১৭ ভোট। প্রতীক টেবিল ঘড়ি। তাবিথ আউয়াল পেয়েছিলেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ৮০ ভোট। তাঁর প্রতীক ছিল বাস। এবারে তাঁরা দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করছেন।

সাঈদ খোকন পৌনে পাঁচ বছর মেয়র ছিলেন। তিনি দৃশ্যমান কোনো সাফল্য দেখাতে পারেননি। আনিসুল হক কাজ করার সময় পেয়েছিলেন দুই বছরের কম। এই স্বল্প সময়ে তিনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঢাকাকে গ্রিন ও ক্লিন করতে না পারলেও বেশ কিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। সড়কগুলো প্রশস্ত করেছেন। গাবতলী সড়ককে যানজটমুক্ত করেছেন। তেজগাঁওয়ে অবস্থিত ট্রাকস্ট্যান্ড সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। উত্তর সিটি করপোরেশন অফিসকে দালাল ও তদবিরবাজমুক্ত করেছেন। আনিসুল হক কারওয়ান বাজার মার্কেটও সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের আগেই তাঁকে মৃত্যুর কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হয়। উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ মেয়র পদে দলের পুরোনো নেতা-কর্মীদের মধ্য থেকে কোনো যোগ্য প্রার্থী না পেয়ে ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল ইসলামকে বেছে নেয়। এবারের নির্বাচনে উত্তরে তিনি টিকে গেলেও দক্ষিণে সাঈদ খোকন বাদ পড়েন। দল নতুন প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয় শেখ ফজলে নূর তাপসকে, যিনি সাংসদের পদে ইস্তফা দিয়ে মেয়র পদে লড়ছেন।

আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদল করে জানিয়ে দিয়েছে, তারা কেমন মেয়র-কাউন্সিলর চায়। কেমন মেয়র কাউন্সিলর চায় না। আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর সরকারের সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানে ধরা পড়েছেন। কয়েকজন পালিয়ে আছেন। এঁরাও আমাদের জনপ্রতিনিধি।

প্রার্থীদের ভালো-মন্দ বিচার তখনই সম্ভব, যখন নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়। নাগরিকেরা নির্ভয়ে পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। অভিন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে দুবার, ১৯৯৪ সালে ও ২০০২ সালে। সেই নির্বাচন নিয়ে তেমন বিতর্ক ছিল না। বিভক্তি সিটি করপোরেশনে নির্বাচন একবারই হয়েছে, ২০১৫ সালে।

১ ফেব্রুয়ারি সরকার ও নির্বাচন কমিশন উভয়ের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। একজন কমিশনার ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, কেমন নির্বাচন চাই এবং কেমন নির্বাচন চাই না। তিনি বলেছেন, বরিশাল, গাজীপুর ও খুলনার পুনরাবৃত্তি চাই না। এই তিন সিটি নির্বাচনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। ২০১৫ সালের নির্বাচনটি হয় রকিব কমিশনের অধীনে। সেই নির্বাচনও বরিশাল বা গাজীপুরের চেয়ে ভালো কিছু ছিল না। ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি, কেন্দ্র দখল, বিরোধী দলের প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেওয়া, ব্যালট পেপারে ইচ্ছামতো সিল মারাসহ নানা অঘটন ঘটে। ফলে সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে নগরবাসীর মনে ভয়, হতাশা ও নির্লিপ্ততা থাকা অস্বাভাবিক নয়। নগরবাসী শুধু বরিশাল, খুলনা বা গাজীপুর নয়, ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেরও পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না।

৩.

বিলম্বে হলেও কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান জানিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন দুই দিন পিছিয়ে দিয়ে শুভবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। তবে তারা কাজটি স্বেচ্ছায় ও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করেনি। হিন্দু সম্প্রদায়ের অব্যাহত প্রতিবাদ, ছাত্রদের আমরণ অনশন এবং জাতীয় হিন্দু ঐক্যজোটের ভোট বর্জনের ঘোষণার মুখে এটি করতে বাধ্য হয়েছে। তারপরও ভোটারদের একাংশের অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। সেই সঙ্গে কমিশনের পদাধিকারীদের বলতে চাই, এটি হলো প্রাক্‌-বাছাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। আসল পরীক্ষা হবে ১ ফেব্রুয়ারিই। সেই পরীক্ষায় যদি তাঁরা উত্তীর্ণ না হতে পারেন, তাহলে ভোটাররা তাঁদের ক্ষমা করবেন না।

নির্বাচন কমিশনকে মনে রাখতে হবে, বিচারপতি আবদুর রউফ ১৯৯১ সালে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছিলেন। কিন্তু এক মাগুরা কেলেঙ্কারি তাঁর জন্য কাল হয়েছিল। ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকার কারণে বিচারপতি এম এ আজিজ ২০০৭ সালে নির্ধারিত নির্বাচনটিই করতে পারেননি। কিন্তু কে এম নূরুল হুদা কমিশন নির্বাচনের নামে একের পর এক প্রহসন দেখিয়ে চলেছে। জাতীয় কিংবা স্থানীয় কোনো নির্বাচনই তারা ভালোভাবে করতে পারেনি। তাই, অনেকে ঠাট্টা করে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নাম দিয়েছেন ‘প্রহসন কমিশন’।

প্রশ্ন হলো, ঢাকা সিটির নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনাররা শক্ত হাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের বাধাগুলো দূর করবেন, না রকিব কমিশনের পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন? তাঁদের মনে রাখা দরকার, জনগণের ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে। ১ ফেব্রুয়ারির ভোটাভুটিতে যেই দলের যেই জিতুক না কেন, নির্বাচনটি যেন প্রহসনে পরিণত না হয়।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]