আইসিজের আদেশ কতটা তাৎপর্য বহন করে

মাইকেল এ বেকার
মাইকেল এ বেকার

গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর যে মামলা করেছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) ২৩ জানুয়ারি অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ বলতে এমন এক জরুরি পদক্ষেপকে বোঝানো হচ্ছে, যা মামলার কার্যক্রম শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভুক্তভোগী রোহিঙ্গাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। এই মামলার চূড়ান্ত রায় হতে বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে। এই সময়কালে যাতে রোহিঙ্গারা নতুন করে নির্যাতনের শিকার না হয়, তা এই অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নিশ্চিত করবে। মিয়ানমারে এখনো প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা আছে। তারা সে দেশের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তাকর্মীদের দ্বারা গণহত্যার শিকার হতে পারে—এমন আশঙ্কা তুলে ধরে গাম্বিয়া আইসিজের কাছে এই অন্তর্বর্তী পদক্ষেপের আদেশ প্রার্থনা করেছিল।

১৭ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত প্যানেলের সবাই অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। তাঁরা এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী চরম অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। আইসিজের আদেশে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে সরকারকে অবশ্যই সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীসহ যেকোনো শক্তির দ্বারা রোহিঙ্গা নিধন ঠেকাতে হবে। (আদালত বলেছেন, ১৯৪৮ সালে জেনোসাইড কনভেনশন অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে)। আদেশে আরও বলা হয়েছে, মিয়ানমারকে অবশ্যই ধ্বংসযজ্ঞের আলামত ও প্রমাণ নষ্ট করার যাবতীয় তৎপরতা ঠেকাতে হবে এবং আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে মিয়ানমার কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা নিয়মিত ভিত্তিতে আইসিজেকে অবহিত করতে হবে।

প্রথমত, আইসিজে কী কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, শুধু তাই বোঝা জরুরি নয়, বরং আইসিজে যে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি, সেটা বোঝাও গুরুত্বপূর্ণ। মামলার এই পর্যায়ে শুধু রোহিঙ্গাদের অধিকার অপূরণীয় ক্ষতির মুখে থাকার বিষয়ে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এই অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ গ্রহণের আদেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নিশ্চিহ্ন হওয়ার হাত থেকে আপাতত রক্ষা করা যায়। কিন্তু আইসিজে এখনো এই সিদ্ধান্তে উপনীত হননি যে মিয়ানমার ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে কি না বা ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত যেসব রোহিঙ্গা নিধন হয়েছে, তাকে আইনি সংজ্ঞায় গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা হবে কি না। এ দুটো বিষয়ই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মিয়ানমার আসলেই গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছিল কি না। এখনো আদালত তা নিয়ে উপসংহারে পৌঁছাতে পারেননি। এসব প্রশ্নের ফয়সালা না করেই আদালত আপৎকালীন পদক্ষেপ হিসেবে এই অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, এই আদেশ দেওয়ার বিষয়ে বিচারকদের সর্বসম্মতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এমনকি এই বেঞ্চে মিয়ানমারের পক্ষ থেকেও যে বিচারককে নিয়োগ করা হয়েছে, তিনিও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন এবং গাম্বিয়া মামলাটি ঠিকমতো উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে যে বিতর্ক তোলা হয়েছিল, তা–ও সবাই নাকচ করে দিয়েছেন। চীন, ভারত, জাপান ও রাশিয়ার বিচারকেরাও আদালতের আদেশে সমর্থন দিয়েছেন। বিচারকদের বেঞ্চের বিচারক জু, যিনি চীন থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন, একমাত্র তিনিই আলাদাভাবে তাঁর মতামত লিখেছেন। এই বিচারকের আদেশ সমর্থন সবাইকে যথেষ্ট অবাক করেছে। তিনি শুরু থেকেই বলে আসছিলেন, গাম্বিয়া যেহেতু মিয়ানমারের তৎপরতায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত নয়, সেহেতু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তার এই মামলা করার এখতিয়ার আছে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। চীনা বিচারক জু মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর প্রমাণ নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনিও অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার হয়ে থাকুক বা না থাকুক, বর্তমানে তারা যে অবস্থায় আছে, সেই মানবিক দিক বিবেচনায় তিনি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এই ভোট দিয়ে থাকতে পারেন।

তৃতীয়ত, আইসিজের এই আদেশ গাম্বিয়া এবং রোহিঙ্গাদের জন্য সুস্পষ্ট বিজয় হওয়া সত্ত্বেও এটি মনে রাখতে হবে, গাম্বিয়া যা চেয়েছে, এই আদেশে সে তা এখনো পায়নি। উদাহরণস্বরূপ, রোহিঙ্গা নিধন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে মিয়ানমারকে আইসিজে আদেশ দিন—গাম্বিয়া শুধু এটুকু চায়নি। গাম্বিয়া এটাও চেয়েছে যে আদালত সুনির্দিষ্টভাবে বলে দিন যে মিয়ানমারের এই কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, যৌন সহিংসতা এবং গ্রামগঞ্জ ও বাড়িঘর ধ্বংস করা হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে। আদালত গাম্বিয়ার শেষোক্ত আবেদন গ্রহণ করেননি। ফলে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়ে মিয়ানমার আদালতের আদেশ ঠিকমতো মেনে চলবে কি না, তা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে বিতর্ক দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘের তদন্তকর্মীদের মিয়ানমারে ঢুকতে দিতে দেশটির সরকারকে নির্দেশ দেওয়ার জন্যও আদালতের কাছে গাম্বিয়া আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু আদালত মিয়ানমারকে সে আদেশ দিতে রাজি হননি।

তদন্ত কর্মকর্তারা বর্তমানে মিয়ানমারের বাইরে থেকে, মূলত প্রতিবেশী বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবির থেকে তাঁদের তদন্তকাজ চালাচ্ছেন। দুঃখজনক বিষয় হলো, এই আবেদন খারিজ করার বিষয়ে আদালত কোনো ব্যাখ্যা দেননি।

বস্তুত এই মামলা শেষ পর্যন্ত দুই পক্ষের করা দুটি তদন্ত প্রতিবেদনের লড়াইয়ের দিকে যাচ্ছে। একটি হলো জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত দলের প্রতিবেদন, অন্যটি হলো মিয়ানমার সরকারের গঠিত ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব ইনকোয়ারির (আইসিওই) প্রতিবেদন। গাম্বিয়া ও রোহিঙ্গারা যখন জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভরসা করে আছে, তখন মিয়ানমার আইসিওইর প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেছে। পুরো প্রতিবেদন প্রকাশ করা না হলেও সারসংক্ষেপই জাতিসংঘের তদন্ত কর্মকর্তাদের বক্তব্যের সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। আইসিওইর প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সেনাবাহিনীর চালানো অভিযানে কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু সেখানে কোনো গণহত্যা সংঘটিত হয়নি। মিয়ানমার যদি আইসিজেতে এই প্রতিবেদন দাখিল করে দায়মুক্তি প্রার্থনা করতে চায়, তাহলে তাদের পুরো প্রতিবেদন করা উচিত, যাতে প্রতিবেদনটি সবাই যাচাই করতে পারে। আইসিইও প্রতিবেদনকে নিরপেক্ষ ও মানসম্পন্ন হিসেবে মনে করা হচ্ছে না। তারপরও গাম্বিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রতিবেদনের অসারতা প্রমাণ করতে হবে।

শেষ কথা হলো, আদালতের এই আদেশ কি আদতেই বর্তমান অবস্থাকে বদলে দিতে পারবে? এমন একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এটি সত্যি যে আইসিজের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ অনেক দেশই মেনে চলে না। অভিযুক্ত দেশটির ওপর সংশ্লিষ্ট দেশগুলো কতটুকু রাজনৈতিক চাপ দেবে এবং তাকে আদেশ মানতে বাধ্য করতে অন্য দেশগুলো কতটুকু আন্তরিক ভূমিকা রাখবে, সেটি বিবেচ্য বিষয়।

তবে আশা করা যায়, এই আদেশের ফলে মিয়ানমার যে মাত্রায় আবার রোহিঙ্গা নির্যাতনে উদ্যত হবে বলে মনে করা হচ্ছিল, তা থেকে হয়তো তারা পিছু হটবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের চরম বিপর্যয়কর অবস্থাকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নেওয়ার এই আদেশ অবশ্য তাৎপর্যপূর্ণ। আইসিজে যদি এই আদেশ না দিতেন, তাহলে মিয়ানমার সরকার কী পরিমাণ বেপরোয়া হয়ে উঠত, তা যে কেউ সহজেই অনুমান করতে পারে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত
মাইকেল এ বেকার: ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের আইনের অধ্যাপক