রোহিঙ্গা প্রশ্নে আর ভুল নয়

মায়ামার সব কৌশলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ বন্ধ করতে চাইছে। ছবি: এএফপি
মায়ামার সব কৌশলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ বন্ধ করতে চাইছে। ছবি: এএফপি

২০১৮ সালের ১৪ এপ্রিল মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি রোহিঙ্গা পরিবারকে ফেরত নেয়। মিয়ানমারের পত্রপত্রিকা-টিভি মিডিয়ায় সেই খবর এতটাই ফলাও করে প্রচার করা হয় যেন মিয়ানমার বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কাজটি জানপ্রাণ ঢেলে শুরু করে দিয়েছে। সেই ফাঁদে পা দিয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাও খবরটি করে প্রচার করে। অথচ পরিবারটি কোনো ক্যাম্পেই আশ্রয় নেয়নি। মিয়ানমার তাদের ফিরিয়ে নিয়েছিল নো-ম্যানস ল্যান্ড থেকে।

‘হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশন’ এবং ‘রোহিঙ্গা পার্লামেন্ট’ নামে মালয়েশিয়ার দুটি সংস্থা কয়েক দিনের মধ্যেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় যে প্রত্যাবাসনটি মিয়ানমার পক্ষের একটি লোকদেখানো নাটক এবং ‘আই-ওয়াশ’। সেই সময় কানাডার কনফ্লিক্ট অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একটি রোহিঙ্গা গবেষণা প্রকল্পের মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ চলছিল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. কাওসার আহমেদ ও এই লেখকের নেতৃত্বে। রোহিঙ্গা তথ্যদাতাদের বেশির ভাগই জানালেন, প্রকৃতপক্ষে তথাকথিত প্রত্যাবাসিত পরিবারটি ছিল মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের নিয়োজিত গুপ্তচর। যখনই তাদের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে পড়েছিল, ঠিক তখনই প্রত্যাবাসনের নামে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদের সরিয়ে নেয়। পরের সপ্তাহেই মালয়েশিয়ার পূর্বোক্ত দুটি সংগঠনের প্রেস বিজ্ঞপ্তি এই অনুমানটির সত্যতা নিশ্চিত করে।

অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্রেড্রিক জন প্যাকার একজন জেনোসাইড ও আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইন বিশেষজ্ঞ। ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর কানাডার শীর্ষস্থানীয় পলিসি থিংকট্যাংক কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল (সিআইসি) ‘রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কানাডার করণীয়’ বিষয়ে একটি বিশ্লেষণী সংলাপের আয়োজন করে। সেখানে তাঁর বক্তব্য ছিল এই যে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনায় ভুল করেছে। যেখানে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন অনায়াসে পাওয়ার সুযোগ ছিল, সেখানে বল উল্টো মিয়ানমারের কোর্টে ঠেলে দিয়েছে। কানাডীয় মিউজিয়াম ফর হিউম্যান রাইটসে অনুষ্ঠিত সংলাপটিতে অধ্যাপক ফ্রেড্রিক জন প্যাকারের সঙ্গে প্যানেলিস্ট হিসেবে এই লেখক, ড. কাওসার আহমেদ এবং জাদুঘরের গবেষণাপ্রধান ড. জোডি জেইসব্রেখটকে মিয়ানমার-বাংলাদেশের প্রত্যাবাসনবিষয়ক সমঝোতা স্মারকের কার্যকারিতা-অকার্যকারিতা সম্পর্কেও আলোচনায় নামতে হয়েছিল। আমাদের চারজনের আলোচনা যে একই বিন্দুটিতে এসে মিশেছিল, তা ছিল—সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করা বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারের সময়ক্ষেপণ কূটচালের ফাঁদে পা দেওয়া ছাড়া কিছু নয়। ফলে চুক্তিটি সাফল্য অর্জনের নিয়ামক না হয়ে সাফল্যের পথে বড়সড় বাধা হয়ে উঠবে।

এই ভবিষ্যদ্বাণীটির যথার্থতা লক্ষণীয়। ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বরে স্বাক্ষরিত স্মারকের অগ্রগতি বলতে দফায় দফায় অনেকগুলো দ্বিপক্ষীয় বৈঠকই শুধু হয়েছে। সিদ্ধান্ত হলো, মিয়ানমার কয়েকটি ধাপে প্রত্যাবাসন করবে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ প্রথম ধাপে ৮ হাজার ৩২ জনের তালিকাও হস্তান্তর করেছিল। আবারও মিয়ানমারের নানা রকম টালবাহানা শেষে ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন শুরুর সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তই সার। সাধারণ্যে এই প্রশ্ন এখনো প্রবল যে বাংলাদেশ কেন বুঝতে পারল না এটি ছিল মিয়ানমারের তৈরি করা এক ধরনে ফাঁদ ও সময়ক্ষেপণের তরিকা! এই স্মারক স্বাক্ষরের আগে বাংলাদেশ ব্যাপকভিত্তিক পর্যালোচনা বা খুঁটিনাটি কূটনৈতিক বিশ্লেষণ কিছু করেনি সম্ভবত! খুবই অল্প সময়ে স্বল্প গবেষণায় এই স্মারকে স্বাক্ষর বাংলাদেশের জন্য লাভের না হয়ে বরং ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

নইলে বাংলাদেশ সরাসরিই জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে পারত, যে রকমটি গাম্বিয়া করেছে। সমঝোতা স্মারকটির কারণেই বরং বিষয়টি হয়ে গেল ‘দ্বিপাক্ষিক সমাধানের বিষয়’। ফলে বাংলাদেশ আইসিজেতে বিষয়টি উত্থাপন দূরের কথা, আন্তর্জাতিক মহলের সাহায্য চাওয়ার সক্ষমতাও হারাল। আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে সমস্যাটি তুললেই মিয়ানমার তো বটেই, ভারত, চীন, রাশিয়াসহ আসিয়ানভুক্ত কিছু দেশও মিয়ানমারের সমর্থনে হই হই করে উঠতে পারে। কারণ মিয়ানমারে তাদের ব্যাপক অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর এই মর্মে চাপও তৈরি করতে পারে, সমস্যাটি তোমাদের দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করার কথা! এমনকি জাতিসংঘের অন্য যেকোনো সদস্যরাষ্ট্রের সমর্থনও উল্টো মিয়ানমারের পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যেতে পারে।

গত বছরের মাঝামাঝিই গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী আবুবকর তাম্বাদু বাংলাদেশে আসেন। রুয়ান্ডায় গণহত্যার বিচারকাজে অংশ নেওয়ার কারণে তাঁর অভিজ্ঞতা ও সুখ্যাতি ছিল। তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর দু-একটি পরিদর্শনের আগে অনুমানও করতে পারেননি অবস্থা এতটাই ভয়াবহ। সঙ্গে সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিষয়টি নিয়ে চুপ করে থাকার কোনো সুযোগই নেই। তিনি ইসলামি সম্মেলন সংস্থাকে সক্রিয় করতে উঠেপড়ে লাগলেন। ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) নিয়ে অনেকেরই নানা রকম ওজর আপত্তি রয়েছে। সাধারণ্যে অসন্তোষ এই যে সংস্থাটি একেবারেই অকার্যকর এবং মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ রক্ষায় কোনো কাজেই আসছে না। তবে তিন দশকের মধ্যে এবারই সংস্থাটি আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরে গাম্বিয়াকে সহায়তাদানের মতো অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ কাজটিতে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছে। দ্রুত সাফল্যও পেয়েছে। গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজে যে যুগান্তকারী আদেশ<টি দিয়েছেন, তার পেছনে ওআইসির সক্রিয়তা এবং আন্তরিক সদিচ্ছা দুটোই ছিল বলেই সাফল্যটি এসেছে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহল অবশ্য এই কথা বলে খানিকটা বাহবা নিতে চায়, তা্রাই ওআইসিকে উদ্বুদ্ধ করেছে গাম্বিয়াকে দিয়ে মামলাটি করানোর জন্য। কারণ, প্রত্যাবাসন চুক্তি স্বাক্ষরের কারণে বাংলাদেশের পক্ষে মামলাটি করার সুযোগ ছিল না।

আদেশটিকে কেন দৃষ্টান্তমূলক বা যুগান্তকারী বলা যায়? প্রথমত, এটি শুধুই আদেশ বা ভাষ্য নয়, বরং মিয়ানমারের প্রতি কড়া ও সুস্পষ্ট নির্দেশ। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে ‘গণহত্যা বন্ধে যত রকম যা কিছু করা প্রয়োজন, মিয়ানমারকে সব ব্যবস্থাই করতে হবে।’ আন্তর্জাতিক বিচারালয় [ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস, সংক্ষেপে আইসিজে] জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আইনি সিদ্ধান্তদাতা সংস্থা। ধরে নেওয়া হয় যে আন্তর্জাতিক বিবাদ নিষ্পত্তিতে আইসিজের যেকোনো সালিসি, রায় ও নির্দেশ অবশ্য-পালনীয়। কোনো সদস্যরাষ্ট্রকে কোনো নির্দেশ দেওয়া হলে, সেই রাষ্ট্র সেটি পালনে বাধ্য। আরেকটি কারণ, আইসিজের নির্দেশনাটি সোজাসাপ্টা এবং একেবারেই স্পষ্ট। আদেশে ‘তবে’, ‘কিন্তু’ বা ‘শর্ত থাকে যে’ ধরনের বিশেষ কোনো শব্দ নেই যে মিয়ানমার ‘নির্দেশনা সহজবোধ্য নয়’ ধরনের অভিযোগ তুলে কোনো নতুন ছুঁতা বা অজুহাতের কৌশল নিতে পারে। এতে এমন কোনো দ্ব্যর্থতাবাচক নির্দেশনাও নেই যে শব্দের ফাঁকফোকর বের করে মিয়ানমার সময়ক্ষেপণের কৌশল নিতে পারে। আদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি দিক এই যে প্যানেলের ১৭ জন বিচারকের সবাই-ই অভিন্ন মতে এককাট্টা হয়েছেন।

আদেশটি দৃষ্টান্তমূলক হলেও প্রয়োগটি যথাযথ হবে কি হবে না, সন্দেহ কিন্তু থেকেই যায়। মিয়ানমার ইতিমধ্যেই আদেশে অসম্মতি জানিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। সম্প্রতি চীন রাখাইন প্রদেশে অত্যাধুনিক বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে তোলার জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই অঞ্চলে রেললাইন এবং তেল ও গ্যাসলাইন স্থাপনের কাজটি প্রায় সম্পন্নই করে এনেছে চীন। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সম্ভাবনার কথাও জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে ওআইসির পরবর্তী কর্মকাণ্ড ও ভূমিকা কী রকম হওয়া প্রয়োজন? আদেশ পক্ষে গেছে বলে গা ছাড়া দেওয়ার সুযোগ নেই নিশ্চয়ই! পর্যালোচনায় আনা প্রয়োজন, ওআইসি ‘মুসলিম’ দেশের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা হওয়ার কারণে মিয়ানমার ‘মুসলিম-অমুসলিম’ প্রসঙ্গ তুলে আন্তর্জাতিক মহলকে বিভ্রান্ত করতে পারে কি না বা তার সম্ভাবনা কতটুকু? অথবা বর্তমানে যে মিয়ানমারবিরোধী আন্তর্জাতিক মনোভাব রয়েছে, ‘ধর্ম’ প্রসঙ্গ টেনে তাকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে কি না?

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বেলায় আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশের ভূমিকা অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট। আপাতসত্য এই যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিনিধিত্বকারী এই সংস্থাটিকে সচল ও সক্রিয় করা প্রয়োজন। অন্যদিকে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক রাষ্ট্রসংঘ ‘সার্ক’ বর্তমান সময়ে যদিও অকার্যকর প্রতিষ্ঠানের পরিণত হয়েছে, বাংলাদেশ উদ্যোগী হলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে সার্ককেও সক্রিয় করা সম্ভব। সবকিছু ছাড়িয়ে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের সক্রিয় সমর্থন আদায়ের বিকল্প নেই। আইসিজের অদেশের ফলে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সমঝোতা স্মারক আর আগের মতো পথের কাঁটা নয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনে মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের দ্বারা অব্যাহত কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টিতে বাংলাদেশের সক্রিয় হয়ে ওঠার এটিই মোক্ষম সময়। উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে কানাডার সিআইসির সংলাপে একটি সমস্বর পরামর্শ উঠে আসে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জন্য যদি কখনো কোনো সুযোগ তৈরি হয়, সামান্য সময়ের অপচয় না করেই বাংলাদেশের সেই সুযোগটি সদ্ব্যবহারে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।