ধর্ষণের সাক্ষ্য আইন

অভিশপ্ত ধর্ষণ দেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে সাক্ষ্য আইনের একটি ত্রুটিপূর্ণ বিধান অবিলম্বে বাতিলের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই ধারা নিজেই একটি কালাকানুন এবং মানবতা ও নারীর জন্য অবমাননাকর। কারণ, ধর্ষণ মামলায়, ‘অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা কি না’—এ রকম একটি প্রশ্ন আইনগতভাবে তোলার সুযোগ রাখা হয়েছে। এবং নারী নির্যাতনের ঘটনার রেকর্ড সৃষ্টিকারী একটি সমাজব্যবস্থায় এর অপব্যবহার ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে।

এটা পরিতাপের বিষয় যে অভিন্ন ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকারী দেশ ভারত ও পাকিস্তান ওই ধারা বাতিল করলেও বাংলাদেশ এ বিষয়ে উদাসীন রয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতার যে একটি রাজনৈতিক দিক রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। এটা নাকচ করা যাবে না যে নারীর প্রতি দৃষ্টি ও মনোভঙ্গি তৈরিতে প্রচলিত আইনের অসামান্য প্রভাব রয়েছে। সাক্ষ্য আইনের এই বিধানই নারীবিরোধী একমাত্র বিধান নয়। প্রচলিত আইন ও ব্যবস্থায় আশু সংস্কারের দাবি রাখে, এমন আরও বহু উপাদান রয়েছে।

ধর্ষণের ক্ষেত্রে টু ফিঙ্গার টেস্ট বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শতভাগ নির্ভুল নয় এবং এই পরীক্ষার মাধ্যমে অনেক সময় কোনো উপসংহারেও পৌঁছানো সম্ভব হয় না। বিশেষজ্ঞরা এটা জানতেন এবং এ ব্যাপারে জ্ঞানেরও ঘাটতি ছিল না। কিন্তু নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার ক্ষেত্রে ঘাটতি ছিল। আর সে কারণেই এই একটি সংস্কার আনতে বাংলাদেশকে দশকের পর দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে নারী বা নারীর প্রাধান্যনির্ভর সংগঠনগুলোকেই যথারীতি সোচ্চার থাকতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও এই কালাকানুনের শৃঙ্খল ভাঙতে নারীর পাশে আইনসভাকে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। তারা কখনো সংসদে একটিও দীর্ঘ সময়ব্যাপী সাধারণ আলোচনার আয়োজন করেনি। বিদ্যমান আইনের ত্রুটি খতিয়ে দেখতে তারা কোনো কমিটি গঠনে উদ্যোগী হয়নি।

২০১৮ সালে এসে উচ্চ আদালতকেই টু ফিঙ্গার টেস্ট নিষিদ্ধ করতে হলো। পর্যবেক্ষণ দিতে হলো যে ধর্ষণ প্রমাণে শারীরিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে এই টেস্টের কোনো বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তি নেই। মানবাধিকারকর্মীরা প্রশ্ন তোলেন যে ধর্ষণের শিকার একজন নারীকেই কেন প্রমাণ করতে হবে তিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন? বরং এটা হওয়া উচিত যে ধর্ষককে প্রমাণ করতে হবে সে ধর্ষণ করেনি। কিন্তু এ ধরনের যুক্তি বিবেচনায় নিতে হলে সমাজে, রাজনৈতিক অঙ্গনে বা আইনপ্রণেতাদের মধ্যে যে ধরনের সংবেদনশীলতা থাকা দরকার, সেখানে ভয়ানক ঘাটতি রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়।

আইনপ্রণেতাদের তাই উচিত নিজেদের ভূমিকার দিকে তাকানো। তঁারা নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা সুরক্ষায় গত এক দশকে তেমন কোনো সংস্কার আনেননি। সংস্কার আনলেই হয়তো কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠবে না। কিন্তু এটা মার্জনা করা কঠিন যে ধর্ষণের ব্যাপকতায় গোটা সমাজ একটা হতবিহ্বল অবস্থার মধ্যে থাকলেও সংসদ কার্যত নির্বিকার। কিছুদিন আগে নাটকীয়ভাবে সংসদের অধিবেশনে নারীর পক্ষে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পথ অনুসরণের আওয়াজ উঠল। নারী কর্মী ও বিশেষজ্ঞরা স্তম্ভিত, কারণ তাঁরা জানেন যে এ ধরনের মনোভাবের বহিঃপ্রকাশে নারীর নিরাপত্তা বাড়ে না, বরং শেষ বিচারে আরও ভঙ্গুর করতেই সহায়ক হয়।

আমরা বিশ্বাস করতে চাই যে সংসদে অনেকে নিশ্চয় আছেন, যাঁরা নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতায় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে যাঁরা ধর্ষকদের ‘গুলি করার’ পক্ষে মত দিয়েছেন, তাঁদেরই এখন উচিত সাক্ষ্য আইনের তর্কিত ১৫৫(৪) ধারাটি বাতিলের দাবি তোলা। প্রতিবেশী দেশগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে নারীর সপক্ষে কিছু আইনের দ্রুত সংস্কার করা উচিত। আমরা মনে করি, এটা করা সম্ভব হলে ধর্ষণসহ নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বা অবমাননা রোধে চলমান নাজুক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে।