হতাশ জনগণ পরিবর্তনের সুযোগ খুঁজছে: তাবিথ

>

১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ঢাকা উত্তরের বিএনপির প্রার্থী তাবিথ আউয়াল। আসন্ন নির্বাচন ও নগর বিষয়ে তাঁর পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

প্রথম আলো: ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের সঙ্গে আপনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এবার আবার করছেন। এবার এ পর্যন্ত আপনার যে অভিজ্ঞতা হলো, তার সঙ্গে গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কোনো পার্থক্য পান কি?

তাবিথ আউয়াল: ২০১৫ সালের নির্বাচনের তুলনায় যেকোনো বিবেচনাতেই সবকিছু অনেক নিম্নমুখী। প্রচার-প্রচারণা থেকে শুরু করে প্রার্থী, পরিবেশ এবং আইনশৃঙ্খলা—কোনো ক্ষেত্রেই আমার প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এবার আমার ওপর হামলা হয়েছে। গতবার এমন হয়নি। তখন অনেক প্রার্থী ছিলেন। ঢাকা উত্তরে সরকারি দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে আমি ছাড়াও মাহি, সাকি ও রতনের মতো প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তখন ঢাকা নগরীর নানা দিক নিয়ে অনেক ইস্যুভিত্তিক আলোচনা হয়েছিল। তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল। অন্তত নির্বাচনের আগপর্যন্ত একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশ বজায় ছিল। এবার তা নেই।

প্রথম আলো: কেন এমন হয়েছে বলে মনে করেন?

তাবিথ আউয়াল: ২০১৫ সালের নির্বাচনে কী হয়েছে আপনারা জানেন। সেই নির্বাচন ও পরে আরও বিভিন্ন নির্বাচনে জনগণের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনগণ নির্বাচনের ব্যাপারে আস্থা ও উৎসাহ হারাতে বাধ্য হয়েছে।

প্রথম আলো: ২০১৫ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে আপনার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তারপর কী প্রত্যাশা নিয়ে আপনি নির্বাচনে লড়ছেন?

তাবিথ আউয়াল: আমি মনে করি যে আমার দায়িত্বশীল হওয়ার সুযোগ আছে। পরিস্থিতি বদলে দেওয়ারও ক্ষমতা আছে। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার জন্যই নির্বাচন করছি। আমার দল মনে করে আমার সে যোগ্যতা আছে। গত নির্বাচনে আমার মনোনয়ন পাওয়া এবং অংশগ্রহণ একটি পরিবর্তনের পথ তৈরি করেছে। তরুণদের নেতৃত্বে আসার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনেও তরুণ প্রার্থী ইশরাক হোসেন মনোনয়ন পেয়েছেন। আপনি এবার দেখবেন যে বিএনপির তরফে যে কমিশনার প্রার্থীদের এবার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তাঁদের গড় বয়স আগের চেয়ে কমেছে। তার মানে নির্বাচনে আমার অংশগ্রহণ দলের মধ্যে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে যেভাবে ব্যবহার করেছি, তাতে প্রচারণার মান তৈরি হয়েছে। আমি আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সৃজনশীলতা দিয়ে যদি পজিটিভ কন্ট্রিবিউশন করতে পারি, সেটা কম কী!

প্রথম আলো: আপনি বিরোধী দলের প্রার্থী। সরকারি দলের প্রার্থী নির্বাচিত না হলে জনগণ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও সেবা পায় না, এমন কথা প্রচলিত আছে। এবং বাস্তবেও বিভিন্ন সময়ে বিরোধী দলের মেয়রদের প্রতি সরকারের অসহযোগিতামূলক আচরণ দেখা গেছে। এই পরিস্থিতিতে আপনি কী নিয়ে জনগণের সামনে ভোট চাইছেন?

তাবিথ আউয়াল: ১১ বছর ধরে একই সরকার ক্ষমতায় আছে। এই সময়ে ঢাকা দিনে দিনে পিছিয়েছে। বসবাসযোগ্যতা হারিয়েছে। সব ধরনের দূষণে নগরবাসী বিপর্যস্ত। এটা পরিষ্কার যে দলীয় স্বার্থ, দীর্ঘদিনে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট থেকে বের হয়ে আসা সরকারি দলের লোকজনের পক্ষে কঠিন। ফলে পরিবর্তন প্রয়োজন। তাহলেও নতুন কিছু ও ভালো কিছু হবে। মেয়র নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারের ভোট পেতে হবে। ভোটের ও জনসমর্থনের একটি শক্তি আছে। ফলে এখানে সরকার বা কোনো তরফে অসহযোগিতা করে খুব লাভ হয় না। এখন সিলেট ও কুমিল্লায় বিরোধী দলের মেয়ররা দায়িত্ব পালন করছেন। সিলেটের মেয়র বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছেন এবং তা প্রশংসিত হয়েছে।

প্রথম আলো: এবার কেমন নির্বাচন আশা করছেন?

তাবিথ আউয়াল: সম্প্রতি চট্টগ্রাম ও রংপুরে জাতীয় সংসদের দুটি আসনে যে উপনির্বাচন হয়েছে, সেখানে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল হতাশাজনক। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না আসুক, এটাই সরকারি দলের চাওয়া। এটাকেই তারা কৌশল হিসেবে নিয়েছে। নির্বাচনের দিন ভোটাররা যদি ভোটকেন্দ্রে আসেন, তবে একটি গ্রহণযোগ্য ভোট আশা করা যায়। ফলে আমরা চাই ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসুক ও নির্বিঘ্নে ভোট দিক।

প্রথম আলো: ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে বা ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করতে আপনি কী করছেন?

তাবিথ আউয়াল। ফাইল ছবি
তাবিথ আউয়াল। ফাইল ছবি


তাবিথ আউয়াল: আমি এবার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে হেঁটে মানুষের কাছে গিয়েছি এবং যাচ্ছি। এটা বুঝেছি যে জনগণ ভোট দিতে চায়। আমি ভোটারদের ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে এবং ভোট দিতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি। আমি বলছি, আমাকে ভোট না দিলেও আপনি ভোটকেন্দ্রে যান। এর মধ্য দিয়ে আমি আমার পক্ষে ভোট চাইছি।

প্রথম আলো: আপনি ঢাকা উত্তরের মেয়র পদের জন্য লড়াই করছেন। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং জেতার সঙ্গে আপনার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকে যুক্ত করেছেন। এটা কী কৌশল?

তাবিথ আউয়াল: বাংলাদেশের মানুষের এখন কথা বলার স্বাধীনতা নেই। ভোটের স্বাধীনতা নেই। শুধু জাতীয়, সিটি করপোরেশন বা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনই নয়, বাস-ট্রাক মালিক-শ্রমিক সমিতি থেকে শুরু করে সব ধরনের সংগঠনের মধ্যেই নির্বাচনের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গেছে, নষ্ট করা হয়েছে। ভোটের অধিকার চর্চার সুযোগ না পেয়ে জনগণ চরম হতাশার মধ্যে আছে। তারা পরিবর্তনের সুযোগ খুঁজছে। অবাধে ভোট দিতে পারলে এই নির্বাচন জনগণের সামনে একটি সুযোগ হিসেবে হাজির হবে। আমরা ভোট চাইছি এবং একই সঙ্গে একে খালেদা জিয়ার মুক্তির পক্ষে জনগণের ম্যান্ডেট হিসেবে বিবেচনা করছি। এই নির্বাচনে জনগণ যদি বিএনপির প্রার্থীকে নির্বাচিত করে, তবে তা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির পক্ষে জনগণের ম্যান্ডেট হিসেবে বিবেচিত হবে।

প্রথম আলো: ঢাকা শহর সমস্যায় জর্জরিত। আপনি নির্বাচিত হলে কোথা থেকে শুরু করবেন? কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়ার পরিকল্পনা আছে কি?

তাবিথ আউয়াল: আমি আলাদা করে বিশেষ কোনো সমস্যাকে প্রাধান্য দিতে চাই না। ঢাকা একটি অচল শহরে পরিণত হয়েছে। এর বাসযোগ্যতা নেই। সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আমি মনে করি শহর ব্যবস্থাপনার জন্য অনেক ইস্যুকে এক করতে হবে। মশা, জলাবদ্ধতা, ময়লা বা রিসাইক্লিং—সবই এক সূত্রে গাঁথা। আপনি যদি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেন এবং এই কাজ যদি যথাযথভাবে করা যায়, তবে একসঙ্গে অনেক বিষয়ে নজর দেওয়া সম্ভব। বায়ু, শব্দ ও পানিদূষণে নগরবাসী বিপর্যস্ত। নারী-শিশুদের নিরাপত্তা, গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা, পার্কিং সমস্যা, যানজট—নজর দেওয়ার অনেক দিক রয়েছে।

প্রথম আলো: ঢাকা শহরের ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হলেও সঙ্গে অনেক সংস্থা জড়িত। এখানে কোনো সমন্বয় নেই। ঢাকা শহরের দুরবস্থা ও দুর্দশার জন্য অনেকেই এই সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেন। আপনি নির্বাচিত হলে এই সমস্যা কীভাবে সামাল দেবেন?

তাবিথ আউয়াল: দেখুন, সামাজিক ক্ষমতা বলে একটি বিষয় রয়েছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একজন মেয়র নির্বাচিত হলে তিনি সেই শক্তিটি অর্জন করেন। এটা জনগণের এবং ভোটের শক্তি। ঢাকা শহরে কোনো উন্নয়নকাজে রাস্তা কাটাকাটি করতে গেলে সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিতে হয়। একই রাস্তায় একেক সংস্থা যদি একেক সময়ে কাটাকাটি করতে চায়, সে ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন তা না দিলেই পারে। একটি নির্দিষ্ট সময় ঠিক করে বিভিন্ন সংস্থাকে একই সঙ্গে কাজ করতে বলা যায়। এ ধরনের কঠোর অবস্থান নিতে না পারার দায় সিটি করপোরেশনকে নিতে হবে। যেসব সংস্থা ঢাকা শহরের বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত, তারা সেগুলো যথাযথভাবে না করলে জবাবদিহির মধ্যে ফেলতে হবে। তথ্য অধিকার আইনকে কাজে লাগিয়ে কেন তারা পারল না, তা জানতে হবে। এটা আসলে ব্যবস্থাপনার ব্যাপার। ব্যবস্থাপক যোগ্য হলে এটা সম্ভব। সেই যোগ্যতা আমার আছে বলে মনে করি।

প্রথম আলো: নির্বাচিত হলে ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নিয়ে আপনার কাজ করতে হবে। তাঁদের কীভাবে পরিচালনা করবেন তা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

তাবিথ আউয়াল: কাউন্সিলরদের পরিচালনার মূল বিষয় হচ্ছে কঠোরভাবে নিয়মনীতি মেনে চলা। কোনো অনিয়ম বা অভিযোগ পেলে ছাড় না দেওয়া। সাধারণত কাউন্সিলররা বেকার থাকেন। তাঁদের কাজ ঠিকাদারি করা। আমি মনে করি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাউন্সিলরদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা ও মান-মর্যাদা আরও বাড়ানো উচিত। তাহলে তাঁরা এলাকার উন্নয়নে আরও মনোযোগী হবেন। অন্য ওয়ার্ডের সঙ্গে একটা প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করবেন।

প্রথম আলো: সিটি করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা?

তাবিথ আউয়াল: সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা বলতে সেই অর্থে কিছু নেই। নিজস্ব লোকবল নেই, বিভিন্ন পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা আসেন ডেপুটেশনে। তাঁরা কোনো দায়িত্ব অনুভব করেন না। কারণ, এখানে তাঁদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষ হলে নিজের জায়গায় ফিরে যান। ফলে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব লোকবলের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথম আলো: শেষ পর্যন্ত যদি এবারের নির্বচন এবং এর ফলাফল আপনাদের কাছে আগেরটির মতো গ্রহণযোগ্য না হয়, তখন কী করবেন?

তাবিথ আউয়াল: নাগরিকদের সমস্যা ও একটি নগরের নানা দিক ও এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি যে সময় ও শ্রম দিয়েছি, তা নগরের উন্নয়নে কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। আমার আইডিয়া ও চিন্তাভাবনা শেয়ার করব। বলতে পারেন শ্যাডো মেয়র হিসেবে কাজ করব। আর নির্বাচনে কোনো অনিয়ম হলে এর বিরুদ্ধে যত ধরনের আইনি পথ আছে, সব পথ কাজে লাগাব। যেটা আগেরবার করিনি।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

তাবিথ আউয়াল: ধন্যবাদ।