ইরাক থেকে মার্কিন সেনা সরাতে মরিয়া ইরান

মার্কিন সেনারা ২০১১ সালে ইরাক থেকে সরে গিয়েছিল। কিন্তু ইসলামিক স্টেট দেশটির উত্তর ও পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করার পর ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে ২০১৪ সালে তারা আবার ফিরে আসে। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন সেনারা ২০১১ সালে ইরাক থেকে সরে গিয়েছিল। কিন্তু ইসলামিক স্টেট দেশটির উত্তর ও পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করার পর ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে ২০১৪ সালে তারা আবার ফিরে আসে। ছবি: রয়টার্স

ইরান অনেক দিন ধরেই প্রতিবেশী ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের চেষ্টা করছে। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র একজন ইরানি জেনারেল ও একজন ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডারকে হত্যা করার পর ইরান তার এ চেষ্টার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

৩ জানুয়ারি ওই হত্যাকাণ্ডের পর ইরাকের পার্লামেন্ট সে দেশ থেকে মার্কিন সেনাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য বলেছেন, ইরাক থেকে সরে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাই তাঁদের নেই। ট্রাম্প সেই সঙ্গে এ-ও বলেছেন যে ইরাক থেকে যদি মার্কিন সৈন্যদের চলে যেতে হয়, তাহলে দেশটির ওপর এমন অবরোধ আরোপ করা হবে, যা ইরাক ‘আগে কখনো দেখেনি’। ইরাক থেকে মার্কিন সেনা সরানোর জন্য ইরানের এই প্রচেষ্টায় প্রশ্ন উঠছে যে ইরান এর মধ্য দিয়ে কোনোভাবে লাভবান হবে কি না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দুর্নীতি এবং ইরাকের ওপর ইরানের প্রভাব কমানোর দাবিতে সাধারণ জনগণের চলমান বিক্ষোভের সুযোগে ইরান ইরাকে তার অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। আসলে এটি ইরানের একটি কৌশল। ইরান জানে এই কৌশল কাজ করবে। কারণ, ইরাকের জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ শিয়া মুসলমান। ইরান বিশ্বের সর্ববৃহৎ শিয়া মুসলমান-অধ্যুষিত দেশ হওয়ার কারণে ইরাকের শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর তাদের বেশ প্রভাব আছে।

ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার ইরানের পক্ষে একটি বিজয় হবে। কেননা, তেহরান দীর্ঘদিন ধরে মার্কিনবিরোধী মিলিশিয়াদের সমর্থন করার কৌশল অবলম্বন করেছে, যারা কিনা হামলা চালাচ্ছে এবং এর পাশাপাশি তাদের লক্ষ্যের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য ইরাকি আইনপ্রণেতাদের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করছে।

গত ডিসেম্বরে ইরান-সমর্থিত কাতাইব হিজবুল্লাহ কিরকুকের একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে রকেট হামলা চালায়। এতে একজন মার্কিন ঠিকাদার নিহত হন এবং বেশ কয়েকজন মার্কিন ও ইরাকি সেনা আহত হন। এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে পশ্চিম ইরাক ও সিরিয়ায় ইরান-অনুমোদিত মিলিশিয়া ঘাঁটিগুলোতে ভয়াবহ বিমান হামলা চালায়, তারপর ৩ জানুয়ারি ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানের সেনাবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী কর্মকর্তা জেনারেল কাশেম সোলাইমানি এবং ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদি আল মুহান্দিসকে হত্যা করে। বাগদাদের বিমানবন্দর ছেড়ে যাওয়ার সময় এই দুজনকে হত্যা করা হয়।

মার্কিন প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা ইরান ও অন্যদের হতবাক করে দেয়। এটা ছিল ইরাক থেকে সব বিদেশি সেনাকে বহিষ্কারের জন্য ইরানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব ইরাকি পার্লামেন্টে পাস করার অনুরোধ জানিয়ে তেহরানের রাজনৈতিক চাপের ফল।

দ্য সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের লন্ডনভিত্তিক বিশেষজ্ঞ দিনা এসফানদিয়ারি বলেছেন, ‘ইরান বৈধ রাজনৈতিক উপায়ে ইরাক থেকে মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহার চায়। এ জন্য তারা এ ব্যাপারে ইরাকি পার্লামেন্টকে চাপ দিয়েছিল। কিন্তু তার ফল যে এত ভয়াবহ হবে, তা বোঝা যায়নি।’

ওই প্রস্তাবের বৈধতা আছে কি না, তা বিতর্কের বিষয়। কেননা, পার্লামেন্টের যে অধিবেশনে প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়, সে অধিবেশন অনেক কুর্দি ও সুন্নি আইনপ্রণেতা বর্জন করেন। শুধু তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রী আবদেল আবদুল-মাহদি এটি পাস করার ক্ষমতা রাখেন কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সরকারবিরোধী বিক্ষোভের মধ্যে নভেম্বর মাসে আবদুল-মাহদি পদত্যাগ করেছেন, তবে তিনি এখনো তত্ত্বাবধায়কের ভূমিকায় রয়েছেন।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ভেবেচিন্তেই সেনা অপসারণের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন এবং তার বদলে তিনি বলেন, ‘সঠিক কাঠামোটি কেমন হবে, তা নিয়ে ইরাকিদের সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে যাবে ওয়াশিংটন।’

আবদুল-মাহদি এই প্রস্তাবকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়েছেন কিন্তু পাশাপাশি তিনি এ-ও বলছেন যে এই সমস্যা মোকাবিলা করার দায়িত্ব পরবর্তী সরকারের। তবে এমন ইঙ্গিত রয়েছে যে বিদেশি সেনাদের ইরাকে রাখার জন্য তিনি পর্দার আড়াল থেকে কাজ করছেন। প্রকাশ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর যাওয়ার কথা বললেও ইরাক আসলে চায় বিদেশি সেনা থাকুক। এটা ইরাকের ওপর ইরানের শক্তিশালী প্রভাবেরই একটি ইঙ্গিত, বিশেষত শিয়া মুসলমানদের ওপর ইরানের প্রভাব ব্যাপক। বাগদাদে যেকোনো ইরাকি রাজনীতিবিদ, বিশেষত যদি তিনি শিয়া রাজনীতিবিদ হন, ইরানকে প্রকাশ্যে অস্বীকার করা তাঁর রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস, এমনকি মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সুতরাং ইরাকি রাজনীতিবিদেরা যদি প্রকাশ্যে এবং ব্যক্তিগতভাবে ভিন্নমত পোষণ করেন, তাহলে তাতে আমাদের অবাক হওয়া উচিত হবে না।

মার্কিন সেনারা ২০১১ সালে ইরাক থেকে সরে গিয়েছিল কিন্তু উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট দেশটির উত্তর ও পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করার পর ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে ২০১৪ সালে তারা আবার ফিরে আসে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন একটি জোট আইএসের সঙ্গে যুদ্ধে ইরাকি সেনাবাহিনীকে বিমান-সহায়তা দেয়। দেশটিতে বর্তমানে প্রায় ৫ হাজার ২০০ মার্কিন সেনা রয়েছে। তবে ইরান যে তৎপরতা শুরু করেছে, তাতে তারা কয় দিন থাকতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়।

নর্থ শোর নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ডেভিড রাইজিং: মার্কিন সাংবাদিক