প্রক্টররা কেন এমন হন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর আবার সহযোগী অধ্যাপক। জনাবের পিএইচডির অভিসন্দর্ভ কেলেঙ্কারিতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। প্রথম আলোতে এ-বিষয়ক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর দিনভর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা হয়েছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের অনুরাগীরা হতবাক হয়েছেন সহযোগী অধ্যাপকের এই দুর্দশায়। সহযোগী অধ্যাপক কবিরকে নিয়ে ট্রলও (হাস্যরস) হয়েছে প্রচুর। কারণ তিনি একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা প্রক্টরিয়াল দলেরও সদস্য। তিনিই কিনা শেষ পর্যন্ত ৯৮ শতাংশ আরেকজনের প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে নিজের অভিসন্দর্ভে ছাপিয়ে দিলেন!

তাঁর এই কীর্তিতে কমবেশি সবাই বিস্মিত হলেও প্রকৃতপক্ষে বিস্মিত বা অবাক হওয়া কিছু নেই। জনাবের অভিসন্দর্ভ জমা দেওয়া ও ডিগ্রি লাভের প্রক্রিয়াটি দেখলে বোঝা যাবে, পুরো প্রক্রিয়াতেই অনিয়ম হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক ও সহ-তত্ত্বাবধায়কের কেউই নিয়ম মানেননি। অনিয়ম এখন সমাজের প্রতিটি স্তরের স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতিটি পেশায় অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। প্রকৌশলী, চিকিৎসক, সরকারি আমলা, ব্যাংকার—সবার মধ্যেই প্রতিযোগিতা চলছে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবেন। সর্বত্রই অনিয়ম ও দুর্নীতির এক মহোৎসব চলছে। নিয়মকানুনের কোনো বালাই নেই। আজ যদি সংবাদে দেখি কেউ একজন ব্যাংকের দেড় হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছেন তো কয়েক দিন পর শুনি আরেকজন তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন। এই যখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি, তখন শিক্ষকেরাই বা আর এসবের বাইরে থাকেন কী করে। কেউ অন্যের প্রবন্ধ থেকে নিজের অভিসন্দর্ভ তৈরি করছেন, তো কেউ প্রশ্ন ফাঁস করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হচ্ছেন। কেউবা সারা বছর নিয়মিত ক্লাস না করিয়েই বেতন তুলছেন।

প্রকাশিত সংবাদ জানাচ্ছে, সহতত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষর ছাড়াই অভিসন্দর্ভ জমা দেন জনাব সহকারী প্রক্টর। রেজিস্ট্রার ভবন থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হলে তিনি সহতত্ত্বাবধায়ককে অনুনয়বিনয় করে স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আবার জমা দেওয়ায় ডিগ্রি লাভ করেন। অভিসন্দর্ভ রচনায় কুম্ভিলক বৃত্তি অবলম্বন নতুন কোনো উদাহরণ না। উন্নত বিশ্বের অনেক নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়েও কুম্ভিলক বৃত্তির অভিযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কেউ ডিগ্রি পান বলে মনে হয় না। আলোচিত পিএইচডি অভিসন্দর্ভের কোনো ডিফেন্স হয়েছে বলে সংবাদে দেখলাম না। ডিফেন্স হয়ে থাকলে অবশ্যই ডিফেন্স কমিশনের কাছে সহতত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষর না থাকা ও কুম্ভিলক বৃত্তির বিষয়টি ধরা পড়ত। আর একজন অধ্যাপক না পড়েই অভিসন্দর্ভে কীভাবে স্বাক্ষর করলেন? মানবিক কারণে স্বাক্ষর করেছেন বলে সহতত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক জানিয়েছেন। কিন্তু পিএইচডি গবেষণা কোনো মানবিক বিষয় না। এটা পেশাগত বিষয়। এককভাবে গবেষণা পরিচালনা করার দক্ষতা অর্জন করলেই তবে কেউ ডিগ্রি অর্জনের যোগ্য হবেন। এখানে অনুনয়বিনয় বা মানবিকতার কোনো স্থান নেই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) একজন শিক্ষক ২০১১ সালের অক্টোবরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে র‍্যাবের হাতে আটক হয়েছিলেন। জানা যায়, মানবিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্তৃপক্ষ উচ্চপর্যায়ে তদবির করে তাঁকে ছাড়িয়ে আনে। পরের বছরই এই শিক্ষককে সহকারী প্রক্টর করা হয়। কিন্তু বেশি দিন এই পদে থাকতে পারেননি। ওই বছরই ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জোবায়ের হত্যাকে কেন্দ্র করে ছাত্র আন্দোলনের মুখে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর আবারও তিনি ২০১৮ সালের নভেম্বরে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব পান। এর এক মাসের মধ্যেই ভারপ্রাপ্ত প্রক্টরের পদ লাভ করেন। মনে হচ্ছে কিছুটা কুর্কীর্তি না থাকলে প্রক্টর পদের যোগ্যতাই আসে না। তাঁকে প্রক্টর হিসেবে নিয়োগ দেন যেনতেন কোনো উপাচার্য না; দেশের প্রথম নারী উপাচার্য, যাঁর বিরুদ্ধে চাঁদার টাকা বিতরণের অভিযোগ ক্ষমতার সহযোগী ছাত্রসংগঠনের নেতারা নিজেরাই পদ খুইয়েছেন।

সম্প্রতি জাবির আরেক সহকারী প্রক্টর তো আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে আহত হয়ে ক্লিনিকে ভর্তি হন। তবে ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। শিক্ষার্থীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ওদিকে আবার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ছাত্রলীগ নেতার কাছে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সেই ছবি ছাপা হয়েছিল গণমাধ্যমে।

বিএনপির আমলেও একজন প্রক্টর ছিলেন জাবিতে। তিনি ছাত্রদলের কর্মীদের দিয়ে গণমাধ্যমের প্রতিনিধি ও ছাত্রলীগের কর্মীদের মার খাওয়াতেন। আরেকজন কথায় কথায় কারণ দর্শানো নোটিশ দিতেন শিক্ষার্থীদের। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে কাজ করেছি। সংবাদ প্রকাশের দায়ে আমি নিজেও দুবার কারণ দর্শানোর নোটিশ পেয়েছিলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও শিক্ষকদের গল্পের শেষ নেই। অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরদের নানা গল্প শোনা যায়। সবার গল্প লিখলে মহাকাব্য রচিত হয়ে যাবে। এই শিক্ষকেরা কেবল ভুল আর ভুল করেন। একজন অভিসন্দর্ভ নকল করতে গিয়ে আইনের কথা ভুলে যান। আরেকজন ভুল করে বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িয়ে পড়েন। ডাকসুতে ভিপি নুরুর হকদের আধঘণ্টা ধরে পেটানো হলেও ঢাবির বর্তমান প্রক্টর কলাভবন থেকে ডাকসুতে আসার পথ খুঁজে পান না।

যাঁদের পথ বারেবারে বেপথে চলে যায়, তাঁদের এমন দায়িত্ব দেওয়া কেন সেই প্রশ্নটা কি করা যাবে?

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।