ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: নির্যাতন থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচান

এই বছর প্রথম বর্ষে ক্লাস নিতে গিয়ে প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের বললাম, ‘তোমরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি করো আজ, বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করো।’ তখন একজন শিক্ষার্থী দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমরা তো সারা দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘোরাফেরা করি। আমাদের তো ভোর চারটার আগে রুমে যাওয়া নিষেধ।’ ওই শিক্ষার্থী জানাল, সে তিন দিন আগে একটি হলের গণরুমে উঠেছে। সেখানে মধ্যরাতের আগে ঘুমাতে যাওয়া বারণ, কারণ তাদের মধ্যরাতে মিছিলে যেতে হয়।

এই কথা জানার দুই দিন পরই জানতে পারলাম, শুধু ওই শিক্ষার্থীর হলেই নয়, প্রতিটি ছেলেদের হলেই এই চর্চা হচ্ছে। যদি কেউ মিছিলে না যায় বা যেতে না চায়? আমার এই প্রশ্নের জবাবে শিক্ষার্থীরা জানায়, তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হবে গেস্টরুমে, অতিথিকক্ষে নিয়ে মারধর করে ‘অতিথি সৎকার’ করা হবে। তাই হলের ভেতরে থাকলে মধ্যরাতের মিছিলে যেতেই হবে এবং রুমে যাওয়া যাবে না। ছাত্রনেতাদের নাম মুখস্থ করা, তাদের সালাম দেওয়া থেকে শুরু করে আরও কিছু ‘নিয়মকানুন’ তাদের মানতে হবে।

গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছে, এমন সন্দেহে ওই হলের চার ছাত্রকে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প এবং রড দিয়ে পেটানোর পর হল তাদের প্রশাসনের মাধ্যমে পুলিশে দিয়েছে।

নিপীড়নের শিকার হওয়া শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছে, তাদের ‘শিবির সন্দেহে’ ডাকা হয়েছিল এবং তাদের দফায় দফায় হাতুড়ি, মোটা তার (মোটা এই কোএক্সিয়েল তারগুলো স্যাটেলাইট টিভি সংযোগের জন্য ব্যবহৃত হয়) এবং ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পেটানো হয় (সূত্র: প্রথম আলো, ২২ জানুয়ারি)। এরপরের রাতেই এস এম হল ও সূর্য সেন হলে সংঘর্ষ হয়। এটি এখনো সবচেয়ে বড় সত্য যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বড় অংশ আসে অত্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবার থেকেই। যার ফলে হলে একটি আসন তার জন্য অতি আবশ্যক হয়ে ওঠে।

গত অক্টোবরে বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যার পর হলগুলোতে গণরুম, গেস্টরুম ও পলিটিক্যাল রুম সংস্কৃতি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলে। সে সময়কার আলোচনায় অনেকটাই মনে হয়েছিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটি একটি বড়সড় পরিবর্তনের সূচনা করবে। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছুটা শিক্ষার্থী নিপীড়নের বিরুদ্ধে নড়েচড়ে ওঠে। দফায় দফায় মিটিং করে বহিরাগত ও হলে বসবাস করার অধিকারহীন শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এগুলো শুধু নোটিশ বোর্ডের বিষয়। খুব যে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে আমরা স্বস্তি প্রকাশ করব, এমন কিছুই হয়নি। 

ছাত্রনেতাদের আরও পোয়াবারো করেছেন উপাচার্য নিজেই। কয়েক দিন আগে তিনি জানিয়েছেন, প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের হলে আসন দেওয়া যাবে না। এর কারণ হিসেবে আবাস-সংকটকেই দায়ী করেন তিনি। কিন্তু হলে আসন পাওয়া প্রথম বর্ষেই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কেননা তাদের অনেকেরই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্যই ঢাকায় আসা, যাদের অনেকেরই কোনো আত্মীয়স্বজন পর্যন্ত ঢাকায় নেই। হলে আসন না পেলে এই শিক্ষার্থীরা কোথায় থাকবে?

কোনো কোনো হলে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলের বারান্দায় স্থান পায়। তীব্র শীতে বারান্দায় থেকে তিন বছর আগে নিউমোনিয়ায় মারা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজ মোল্লা। এই আবাস-সংকটের পেছনে অন্যতম শক্তি হিসেবে কাজ করছে হলের ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের আসন নিয়ন্ত্রণ এবং আসন বণ্টনে প্রশাসনের দলীয় আনুগত্যকেন্দ্রিক অসহায়ত্ব। ছেলেদের হলের ক্ষমতাসীন সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নিজস্ব ব্যবহারের জন্যই থাকে বেশ কটি রুম। ছাত্রলীগের আসন্ন নতুন কমিটি হওয়া নিয়ে হলগুলোতে চলতে থাকা বিরাজমান বিভিন্ন গ্রুপের ক্ষমতা প্রদর্শনের বলিও হচ্ছে এই নতুন শিক্ষার্থীরা। যারা হলে একটু থাকার জায়গার জন্য আসন না পেয়ে দ্বারস্থ হয় এলাকার বড় ভাইদের, ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের, তারাই রাজনৈতিক এই ‘বাধ্যবাধকতার’ শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। 

ছেলেদের হল ও মেয়েদের হলেও এখন পর্যন্ত প্রথম বর্ষের যারা হলে উঠেছে, তার বেশির ভাগই উঠেছে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে এবং হলে তাদের পরিচয় হয়ে ওঠে ‘পলিটিক্যাল’। আর তখন থেকেই তারা ‘ভাইয়া’ ও ‘আপুদের’ নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং তাদের পরিচয় হয়ে ওঠে ‘ভাইয়া’ আর ‘আপুদের’ কর্মী। ভাইয়া আর আপুদের খুশি করার জন্য তারা হলের বিভিন্ন নিপীড়ন, মারামারি ও অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। যাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে বড় পরিচয় হয়ে ওঠে ‘অমুক সংগঠনের নেতা বা কর্মী’। আর আজকের এই প্রথম বর্ষের ‘বাধ্যগত’ কর্মীরাই আগামী বছর এই নিপীড়নের নেতৃত্ব দেবে, এভাবেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রতি র‍্যাগিংসহ অন্যান্য নিপীড়ন বন্ধ করার জন্য হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিংবিরোধী কমিটি তৈরির নির্দেশ আছে। কিন্তু হলে হলে ছাত্রদের ভোর চারটা পর্যন্ত রুমে ঢোকার অনুমতি না থাকায় এই শীতের রাতে তাদের ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে, এর দায়ভার প্রশাসনকেই তো নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম মাসে এসেই এমন অভিজ্ঞতা অনেককেই স্বপ্ন থেকে ছিটকে দিচ্ছে। ‘পলিটিক্যাল’ভাবে হলে ওঠা দু-চারজন নারী শিক্ষার্থী থেকে শুনলাম হলগুলোত থাকা দোকানে যেতেও অনুমতি নিচ্ছে ‘আপুদের’। কেউ কেউ ভাবছে, এটাই বোধ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম।

আমরা শুনি, দেখি, মাঝমধ্যে হাহাকার করে উঠি। কিন্তু যাদের এ বিষয়ে কার্যকরভাবে সোচ্চার হওয়ার কথা, তারা চুপ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনসহ সবাইকে অনুরোধ করি, আসুন, এই বাচ্চাদের বাঁচাই। ওরা পড়তে এসেছে, ওরা দলবাজি করতে আসেনি। ওরা আমাদেরই সন্তান। তারা যেন প্রশাসনিকভাবেই আসন পায়, নির্বিঘ্নে কাটাতে পারে পাঁচটি বছর। একটা আসন তাদের অধিকার। এই আসনে নিরাপদভাবে থাকার নিশ্চয়তা আমরা কেন দিতে পারছি না?

জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক