এমএলএম ব্যবসার ফাঁদ

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানিগুলো যে ব্যবসার নামে সাধারণ মানুষ তথা গ্রাহকদের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, সেই খবর আর নতুন নয়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, থানায় নিবন্ধিত মামলার ভিকটিমদের ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই আর্থিক প্রতারণার শিকার, যার বড় অংশই ঘটেছে এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমে। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যে পুরো চিত্র উঠে এসেছে, ভাবার কোনো কারণ নেই। স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠনের নামে বহু প্রতারণার ঘটনা ঘটে, যা গণমাধ্যমে আসে না, ভুক্তভোগীরাও থানা-পুলিশকে জানান না।

সহযোগী একটি পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউর মতো প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের পর এমএলএম নিয়ে গ্রাহক পর্যায়ে অনাস্থা দেখা দিলেও অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন নাম ও কৌশলে একই কায়দায় ব্যবসা করে যাচ্ছে। বর্তমানে অন্তত দুই ডজন প্রতিষ্ঠান এই বেআইনি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান অনলাইনে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান কখনো উচ্চ বেতনে চাকরি দেওয়ার নামে কখনো আকর্ষণীয় সুদ দেওয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বিশেষ অঞ্চলকে টার্গেট করে সেখান থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ তুলে নিয়ে চম্পট দেয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে খুলনা, কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা অঞ্চলে সাম্প্রতিক কালে এমএলএম ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠেছে এবং হাজার হাজার মানুষ প্রতারিত হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

এমএলএম ব্যবসার নামে দীর্ঘদিন এই প্রতারণা চলে এলেও যুবক ও ডেসটিনির কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার আগে এ নিয়ে খুব উচ্চবাচ্য হয়নি। প্রথমে যুবক ও পরে ডেসটিনির প্রতারণা জানাজানি হলে সমাজে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও কিছুটা নড়েচড়ে বসে। কিন্তু ডেসটিনি ও যুবক কিংবা অন্যান্য এমএলএম প্রতিষ্ঠানের হাতে প্রতারিত লাখ লাখ মানুষ অর্থ ফেরত পাননি। অপরাধীদের শাস্তিও দেওয়া যায়নি।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে ডেসটিনির ৪৮ জনের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছে, সেই মামলার নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। কবে হবে, তা–ও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসার মাধ্যমে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ডেসটিনির কর্মকর্তারা আত্মসাৎ করেছেন। গ্রাহকের অর্থে তাঁরা নিজেদের নামে বাড়ি-গাড়ি করেছেন। শতকোটির বেশি টাকা পাচারেরও অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানে যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁদের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হবে। তাহলে ডেসটিনি কিংবা যুবকের মতো প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে, তাদের বিচার কেন এত প্রলম্বিত হলো?

২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রণীত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইনে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করার পাশাপাশি পিরামিডসদৃশ বিপণন কার্যক্রম চালানো, সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ মোড়কজাত না করে পণ্য বিক্রি, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পণ্য বা সেবা বিক্রি না করা, পণ্য বা সেবার অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ, নিম্নমানের পণ্য বা সেবা বিক্রি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অথচ আরও সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে তারা সেই কাজটি করছে।

এই প্রেক্ষাপটে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান ও নামে এমএলএম ব্যবসা পরিচালনার খবরটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমরা এমএলএম ব্যবসা পরিচালনাকারী সব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করছি। কোন প্রতিষ্ঠান কত টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে, সেটা খুঁজে বের করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো নামেই এই প্রতারণা চলতে দেওয়া যায় না।