শেয়ারবাজারের বেলুন কেন ফাটে

শেয়ারবাজার
শেয়ারবাজার

পার্মান্যান্স অব অবজেক্ট বলে একটা কথা আছে—বস্তুর নিত্যতা। ধরা যাক এখানে একটা বালুর উঁচু ঢিবি দেখা গেল। তাহলে নিশ্চিত বলা যাবে, কোথাও থেকে সেই বালু কেটে আনা হয়েছে। অর্থাৎ কোথাও গর্ত হয়েছে। কারণ, এই বালুর ঢিবি শূন্য থেকে তৈরি হতে পারে না। ভোগ্যপণ্যও তাই। পেঁয়াজের কথাই ধরা যাক। মানুষ যত, তত পেঁয়াজ নেই। সেটাকে কোনোভাবেই শূন্য থেকে পূরণ করা যাবে না। হয় বাইরে থেকে আনতে হবে। অথবা উৎপন্ন করতে হবে। গাছও সমপরিমাণ বস্তু নিয়ে বেড়ে ওঠে। শূন্য থেকে তার বৃদ্ধি হয় না। অর্থিনীতিও তাই। টাকা, বন্ড, শেয়ার, ব্যাংক চেক, সবকিছুই বিনিময়ের আধুনিক মাধ্যম। একটি গাভির বদলে ১০ মণ চালের সরাসরি বিনিময় যে অসুবিধা, তা সমাধান করতে মধ্যবর্তী একটি মাধ্যম এল—মুদ্রা। হালে তা আবার অনেক রূপ নিয়েছে। শেষে অবশ্য এটি লেজার বুকে রাখা একটি সংখ্যাও হয়ে গেছে। কিন্তু এর পেছনে ধরাছোঁয়ার মতো সম্পদের (অ্যাসেট) শক্তি থাকতে হবে।

সম্পদ একটি ব্যবহারযোগ্য, ধরাছোঁয়ার জিনিস। এক ট্রাক পেঁয়াজ, একটি মোটরসাইকেল, আড়াই কাঠা জমি, একটি তাঁতের শাড়ি, সোনার চুড়ি, একটি কারখানা—এসব সম্পদ। এসব জীবনধারণের উপায়, ভোগ্যপণ্য অথবা কোনো ধরনের সেবার সৃষ্টিতে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। বিনিময় মাধ্যমটি সম্পদের প্রতিশ্রুতিপত্র, সম্পদ নয়। টাকা নিজে সম্পদ নয়। সহজ উদাহরণ, ভারতের সরকার হঠাৎ ৫০০ রুপি নোট বন্ধ করে দিল। সঠিক সময়ের মধ্যে যাঁরা তা ব্যাংকে গিয়ে বদলে নিতে পারেননি, তাঁদের সেই ‘রুপি’ রাতারাতি মূল্যহীন হয়ে গেল। সরকার সেটাকে বাতিল করে দিলে (প্রতিশ্রুতি তুলে নিলে), মুদ্রা তো কাগজ বই কিছু নয়।

কাগুজে মুদ্রা, বন্ড, শেয়ার, এগুলো হলো চুক্তিপত্র। যতক্ষণ না তাকে বিনিময় করা হচ্ছে, ততক্ষণ তারা প্রতিশ্রুতি। তারা নিজে সম্পদ নয়। আপনি বিনিময় করতে করতে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। না, সব ক্ষেত্রে রাতারাতি ঘটবে না। হয়তো কোনো দিনই ঘটবে না। তবে বিষয়টাকে বুঝতে পারা এবং আমলে আনা জরুরি। তার মানে হচ্ছে, আপনার জমির কাগুজে দলিল, আর জুরাইনে আড়াই কাঠার একটি সত্যিকারের প্লটের যে পার্থক্য, প্রতিশ্রুতিপত্র এবং তার সমপরিমাণ সম্পদের মধ্যে একই পার্থক্য। জমির দলিল আছে, কিন্তু জমি না থাকলে তো দলিল একটি কাগজ!

শেয়ারবাজারের বেলুন কখন ফাটে
শেয়ারবাজারের কথায় আসা যাক। একটা বেলুনকে ফোলাতে থাকলে, সেটা বাড়তে বাড়তে অনেক বড় হবে। তারপরও ফোলাতে থাকলে, সেটা ফেটে যাবে। একটা খেজুরগাছ শুধুই লম্বা হতে থাকলে, একসময় সেটা ভেঙে পড়ে মাঝারি খেজুরগাছের থেকেও ছোট হয়ে যাবে। একটা তির ওপরে ছুড়লে, সে একসময় মাটিতে নেমে আসবেই। শেয়ারবাজারও এই নিয়মের ব্যতিক্রম নয়।

শেয়ারবাজারে শেয়ার কেনা একটা বিনিয়োগ। সবাই পারদর্শী বিনিয়োগকারী নন। সবাই ব্যবসায় সফল হতে পারেন না। সেই হিসেবে বিবেচনা করলে, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা, বিশেষত স্বল্পকালীন বিনিয়োগ করে লাভ করাও অন্য ব্যবসার মতোই ঝুঁকিপূর্ণ একটি ব্যাপার। শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস নামলে মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে একে-তাকে দোষ দেয়। এর বা তার কিছুটা বা অনেকটা কারসাজি থাকলেও, প্রথম দায়ী করতে হবে তাকে, যে ঝুঁকি না বুঝেই রাতারাতি দ্বিগুণ-তিন গুণ অথবা দশ গুণ লাভের আশায় সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছে। এত লাভের প্রতিশ্রুতি কেউ তাকে দেয়নি। যারা দিয়েছে, তারা কোনো নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র নয়। বন্ধুবান্ধব, অফিসের কলিগ, অথবা নিকট আত্মীয়রা বলছে, লাভে লাভ। আজকে কিনলে আগামী সপ্তাহে বেড়ে যাচ্ছে। আরও ঢালুন। চারদিকে সবাই এ নিয়ে কথা বলছে। অর্থ লগ্নি করে ঢালছে। এমনকি জায়গাজমি পর্যন্ত বিক্রি করছে। কাগজে–কলমে অন্যের লাভটাও স্বচক্ষে দেখা যাচ্ছে। তাহলে নয় কেন?

এই মানসিকতাকে এলেন গ্রিনস্পেন নাম দিয়েছেন, ‘ইরেশনাল এগজুবারেন্স’, যার বাংলা দাঁড়ায় ‘অযৌক্তিক উদ্দীপনা’। তিনি একসময়ের আমেরিকার ফেডারেল ব্যাংকের ডাকসাইটে চেয়ারম্যান ছিলেন। ‘অযৌক্তিক উদ্দীপনা’ ঘটে বড় ধরনের বিপর্যয়ের ঠিক আগে আগে। সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ডের নিয়মে যত মানুষ শেয়ারবাজারে আসছেন, তত দাম বাড়ছে। ততই বেলুনটি বড় হচ্ছে। কিন্তু একসময় তাকে ফেটে যেতেই হবে। সম্পদকে উৎপাদন ছাড়া বাড়ানো যায় না। লেনদেনের যজ্ঞ তৈরি হলেই সমৃদ্ধি আসছে না।

অযৌক্তিক উদ্দীপনার খেসারত
একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম কত হওয়া উচিত, তা নির্ণয় করার জন্য অনেক তথ্য প্রয়োজন, অনেক হিসাবনিকাশ প্রয়োজন। সেটা সেই বিষয়ে প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ কেউ যেভাবে বুঝবেন, সাধারণ একজন মানুষ সেভাবে বুঝবেন না। আর অত বোঝারই বা দরকার কী? কোনটা বেশি বাড়ছে সেটা জানলেই তো হলো! বাড়ছে যখন, আরও নিশ্চয়ই বাড়বে। যেন একটা তির কিছু সময় ওপরে উঠেছিল দেখে, হলফ করে বলা যায় সেটা অনন্তকাল একই গতিতে শুধু ওপরে উঠতেই থাকবে।

শেয়ারবাজার নিয়ে লাখো মানুষের এই ‘অযৌক্তিক উদ্দীপনা’ বিষয়টাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে সেটা আর স্থিতিশীল থাকে না। ধস অনিবার্য হয়। দাম অনেক বেড়ে গিয়ে হঠাৎ কমতে শুরু করলেই, সবাই হুড়মুড় করে একযোগে বেরিয়ে পড়তে চায়। তাতে দাম আরও কমতে থাকে। মানুষ আতঙ্কিত হয়, শেয়ারের দাম আরও কমে। কমতে কমতে টানা স্প্রিঙের মতো শুধু স্থিতাবস্থায় এসেই বন্ধ হয় না, বিপরীত গতির কারণে আরও সংকুচিত হয়ে যায়। একটি জাহাজের সব যাত্রী কিছু একটা মজার বিষয় দেখার জন্য সামনের দিকে চলে গেলে সেটা সামনে নিচু হয়ে প্রায় ডুবে যেতে চাইবে, তখন সবাই আতঙ্কিত হয়ে পেছনে ছুটবে। তাতে জাহাজ ভারসাম্য ফিরে পাবে না, বরং পেছনটা এবার ডুবি ডুবি করবে। এ হলো জনমনস্তত্ত্ব। এই বিষয়টা ঘটা অবশ্যম্ভাবী।

তেমনি শেয়ারবাজারেও বিষয়টা ঘটছে, ঘটে। যাঁরা একবার দেখেছেন, তাঁরা হয়তো আর সেখানে যান না। কিন্তু নতুন প্রজন্ম আসছে, তারাও আগের প্রজন্মের মতো অযৌক্তিক উদ্দীপনার শিকার হচ্ছে। অথবা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা ভাবছেন ভরাডুবি হওয়ার আগেই লাভ নিয়ে বেরিয়ে আসব। সেটাও শেষ পর্যন্ত হয় না। এই উদ্দীপনা কয়েক মাস থেকে শুরু করে কয়েক বছর চলতে থাকতে পারে। ধস কবে নামবে কেউ হলফ করে বলতে পারবে না। কিন্তু নামবে এবং এর থেকে স্বল্পকালীন মেয়াদে লাভ নিয়ে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব হবে।

শেয়ারবাজারের মূল লক্ষ হচ্ছে বড় বড় ব্যবসা–বাণিজ্যে গণমানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা। ধরা যাক, তানিম অ্যান্ড কোম্পানির শেয়ার কিনলেন। তাহলে সেই তানিম অ্যান্ড কোম্পানি তার শিল্পকারখানা বা ব্যবসা বাড়িয়ে তোলার জন্য নতুন মূলধন পেল। আপনি হলেন বিনিয়োগকারী, সেই কোম্পানির ক্ষুদ্র একজন অংশী হয়ে গেলেন। সেই কোম্পানি লাভ করে ফুলে–ফেঁপে উঠলে তাদের শেয়ারের দাম বাড়বে। তখন আপনিও তাদের লাভের অংশীদার হচ্ছেন। অনেক কোম্পানি বার্ষিক ডিভিডেন্ডও দিতে পারে। কিন্তু শুধু কাগজটাকে (শেয়ার ) উদ্দেশ্য করে বেচাকেনা এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যেখানে সেই কোম্পানির আয়-ব্যয়, ব্যবসার ভবিষ্যৎ, কারা তার ব্যবস্থাপনায় আছে, সেসব কেউ অনুসন্ধান করতে যাচ্ছে না।

কিংবদন্তিতুল্য বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট ব্যাপারটাকে এভাবে বুঝিয়েছেন, আপনি যদি কাউকে গাছের শীতল ছায়ায় বসে থাকতে দেখেন, তার কারণ তিনি ১০–২০ বছর আগে গাছ লাগিয়েছেন। এখন সেই গাছ বড় হয়ে ছায়া দিচ্ছে। আপনার গাছ লাগাতে দেরি হয়েছে, সেটা ঠিক। কিন্তু আপনার জন্য গাছ লাগানোর সবচেয়ে ভালো সময় হলো এই মুহূর্ত। তাহলে আপনিও ১০–২০ বছর পরে শীতল ছায়া পাবেন।

তিনি স্বল্পকালীন লাভের তাড়নাটা মাথা থেকে সম্পূর্ণ দূর করে দিতে বলছেন। বিশ্ব অর্থনীতি ক্রমেই বড় হচ্ছ। কাজেই যতই উত্থান-পতন হোক না কেন, দীর্ঘ মেয়াদে সামগ্রিক শেয়ারবাজারটা বৃদ্ধি পেতেই হবে। তিনি মনে করেন, বিনিয়োগ হওয়া উচিত ১০–২০ বছরের জন্য।

মনুষের মনস্তত্ত্ব, জনতার আচরণ, অর্থনীতিকে বিশেষত শেয়ারবাজারকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এক দিনে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে গেলে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে। টাকা দিতে পারবে না। ব্যাংকে অত টাকা থাকে না। তখন আতঙ্কে যারা যায়নি, তারাও তাদের টাকা তুলতে যাবে। মানুষকে ঠেকাতে নিরাপত্তা বাহিনী নামাতে হবে। অরাজকতা শুরু হয়ে যাবে। একে বলে ‘ব্যাংক রান’।

শেয়ারবাজারে মানুষের মনস্তত্ত্বের প্রভাব বিগত উত্থান–পতনগুলো এবং সাধারণ মানুষের তাতে অর্থ বিনিয়োগের হিড়িক এবং পরিশেষে বিক্রির হিড়িক পর্যালোচনা করলেই বোঝা যাবে। তবে বড় বড় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ, যেগুলো অগ্র–পশ্চাৎ বিবেচনা করে করা হয়, সেগুলোর প্রভাব নিশ্চয়ই আছে। শেয়ারবাজার বিষয়ে সরকারের রেগুলেশন এবং অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রভাব থাকতেই হবে। জালিয়াতিও থাকতে পারে। কম–বেশি সব দেশেই হয়তো আছে। এসবের বাইরেও শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন (বুম অ্যান্ড বাস্ট) পুঁজিবাদী অর্থনীতির একটি অমোঘ নিয়ম।

যা আপনার হাতে আছে, তা হলো এই যৌক্তিক উদ্দীপনাকে অবদমিত করার ক্ষমতা। স্বল্প সময়ে আঙুল ফুলে কলাগাছের স্বপ্ন না দেখা। শেয়ারবাজার এটি জুয়া নয়। এটি একটি বৈধ এবং নিয়ন্ত্রিত অর্থায়নের উপায়। সাধারণ মনুষের জন্যও বিনোয়োগের একটি সহজ এবং সম্ভাবনাময় পন্থা। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করুন, পেশাদার বিনিয়োগকারীর সাহায্য নিন। কিন্তু না বুঝেই গড্ডলিকা প্রবাহে যাবেন না। গড্ডলিকা প্রবাহের ফল ভালো হয় না। সেটাই আসলে শেয়ারবাজারে ধস নামার অন্যতম কারণ।

মোস্তফা তানিম: লেখক