'পাবলিকের মনে আনন্দ নাই' অথবা 'জিতবে এবার...'

ভোট চাইতে কেউ আসেনি
ভোট চাইতে কেউ আসেনি

নির্বাচন নয় যেন বিয়েবাড়ির সাজ সারা শহরে। মাথা তুললেই লাখো পোস্টার, প্রার্থী কিন্তু অল্প কয়েক। চারদিকে আওয়াজ, ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে/ঢাক ঢোল ঝাঁজর বাজে’। এতই বাজে যে কানে তালা লেগে যায়। এর মধ্যে রায়েরবাজারের এক গলিতে ছোট্ট মাচার ওপর বসে আছেন এক বুড়ি। কাস্টমার বলতে মাত্র একজন। তিনিও আরেক বৃদ্ধা। একজনে ভাজে, আরেকজনে খায়। মাথার ওপর শীতের হাওয়ায় লাগলো দোলা—পোস্টারে। অবিরল নৌকার পোস্টারের মধ্যে বিরল মুখে উঁকি দিচ্ছে একটি-দুটি ধানের শীষ। ভোটের গানের আওয়াজে কথা বলার উপায় নেই। একটু পরে, ‘বাজতে বাজতে চলল ঢুলি/ঢুলি গেল কমলা ফুলি’। আগেকার যুগের ভোটে ঢোল বাজত, ঢুলি ভাড়া করা হতো। এখন বাজে ডিজিটাল শব্দযন্ত্র। সুকুমার রায়ের ভাষায়, এতটুকু যন্ত্র হতে এত শব্দ হয়! বাপরে বাপ। শুধু ডিজিটাল শব্দযন্ত্রই না, পিক আপের দুদিকে বিশাল ডিজিটাল ডিসপ্লে। কাঁঠালবাগান-কলাবাগানের রাস্তায় সেই জিনিস দেখেছি।

কিন্তু এটা রায়েরবাজারের গরিব এলাকা। সেই এলাকার ততোধিক দরিদ্র এলাকা হাশেম খান রোড। তারই গলির মধ্যে বুড়ির ছোট্ট টঙের দোকান। তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ‘ভোটের কী খবর?’ তাঁর উত্তর: ‘কী জানি বাবা’ বলে সেই যে চুপ করলেন, মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচন নিয়ে আর কথাই বলেন না। প্রার্থীদের বিষয়ে জানতে চাইলে হাত দিলেন একটা কাগজের বাক্সে। সেখানে পিঠা মোড়ানোর কাগজ রাখা। ‘কই বাবা, কেউ তো কোনো কিছু দিয়া যায় নাই, দিলে তো এইখানেই থাকত।’ হয়তো ভোট নিয়ে তাঁর উৎসাহ নেই। তাঁর উৎসাহ কেবল নিজের দুঃখের কথা বলায়। বুড়ির ছেলেটা রিকশা চালান, কিন্তু বেশিক্ষণ পারেন না। ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই একটু দুর্বল। তাই বুড়িকে বসতে হয়েছে গলির মধ্যে একটা চুলা, একটা তাওয়া আর চালের গুঁড়া নিয়ে চিতই পিঠা বানানোর ব্যবসায়।

এঁরা সেই শ্রেণির মানুষ, সেই জনগণ, যাঁরা বাইরের মানুষের কাছে মুখ খুলতে ভয় পান। ২০১৫ সালের মেয়র নির্বাচনের সময়কার কথা মনে পড়ল। সেবারও তো মানুষ নির্বাচনের কথাবার্তায় উৎসাহ দেখাত। এবার কেন এত ঘোরপ্যাঁচ? আর কিছু না থাকলেও স্বল্পব্যবহৃত একটা হাতিয়ার তাঁদের আছে। তার নাম কাণ্ডজ্ঞান। কাণ্ডজ্ঞান বা কমনসেন্স হয়তো শিখিয়েছে, রাজনীতি নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো। এ-কথা সে-কথার পর বৃদ্ধা মানুষটি মুখ খুললেন, ‘ভোট দিতে দিতে ক্লান্ত। বহু কষ্টে কীভাবে দিন পার করি, তা আমি জানি আর আমার আল্লায় জানে। গত বছর কাউন্সিলরের কাছে গেছিলাম বয়স্ক ভাতার জইন্য। হ্যায় আমারে চেনেই না, কয় কাইলক্যা আসেন। কত কাইলক্যা চইলা গেল, আমি এহন পিডা ভাজি।’

এমন সব দুঃখী মানুষকে বেশি প্রশ্ন করাও একটা অত্যাচার। ইতিমধ্যে সেখানে হাজির দুটি মানুষ। কথায় কথায় বেরিয়ে পড়ল একজন বিএনপির সমর্থক, আরেকজন আওয়ামী লীগের। বিএনপির জন খুদে ব্যবসায়ী। এই এলাকার বিএনপির কাউন্সিলর প্রার্থী মো. মাসুম খান রাজেশ। তিনি স্থানীয় এমপি সাদেক খানের ভাতিজা। খুদে ব্যবসায়ী আলীম হোসেনের ধারণা, ‘নির্বাচন যদি সুষ্ঠু হয়, বুঝলেন, যদি সুষ্ঠু হয় তাহলে বিএনপি প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা।’ কত পার্সেন্ট সম্ভাবনা? বললেন, ‘আশি পার্সেন্ট সম্ভাবনা।’ কেমনে বুঝলেন? বললেন, ‘মিছিল বড় হয় রাজেশের।’ এলাকায় কোনো হাঙ্গামা হয়নি। পরিবেশ যে ভালো, তা নিয়ে দুজনই একমত। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থক রিকশাচালক মো. মাহবুব কে জিতবেন, তা নিয়ে কিছু বললেন না। তাঁর বক্তব্য পরিষ্কার, ‘পরিবেশ তো ভালাই, অহন মানুষ যুদি ভোট দিবার না আসে, বিএনপিঅলারা যদি তাগো ভোটারগো ভোটকেন্দ্রে না আনতে পারে, হেইডা কি সরকারের দোষ?’

দোষ কার, তা নিয়ে দুজনে তর্ক চলমান থাকতে থাকতে এগিয়ে গেলাম বড় রাস্তার দিকে। রাস্তার পাশেই মো. আকবরের হার্ডওয়্যারের দোকান। বললেন, ‘তাবিথ আউয়াল আসছিল, আতিক সাব আসবেন শিগগিরই।’ বিএনপি প্রার্থীর মিছিল বড় হওয়া নিয়ে জানতে চাইলাম। এ ব্যাপারে আকবরের একটা ব্যাখ্যা আছে। বললেন, ‘রাজেশের ভোট কম, সাপোর্ট বেশি।’ সেটা কেমন? ‘এলাকায় ভাসমান মানুষ বেশি, সেটা নিজেই দেখেছি।’ আকবরের বক্তব্য হলো, ‘হেরা বরিশাইল থাইকা আসা মানুষ, অনেকেই এলাকার থন পলায়া আছে। তাগো অনেকেই এইখানের ভোটারই না, তাইলে জিতাইব কেমনে?’ কথায় যুক্তি আছে। আকবর মনে করেন, ভোট সুষ্ঠু হবে। মারামারি না হওয়ার কারণও ব্যাখ্যা করলেন:

‘এই যে রাজেশ সাব, ওনার চাচা হইলেন এলাকার সরকারি দলের এমপি। ফুল ফ্যামিলির সবাই আওয়ামী লীগ, উনি খালি একাই বিএনপি। এমপি সাব কি চাইব তাঁর ফ্যামিলির কেউ হারুক? এই কারণে ওনার (রাজেশের) কোনো ভয় নাই। ওদিকে বিএনপির আরেকজন আবার খাড়াইছেন স্বতন্ত্র হিসেবে ঝুড়ি মার্কা নিয়া। ঝুড়ি মার্কা তো রাজেশেরই ভোট কাটব, হেইডার সুযোগ নিব আওয়ামী লীগ। তাই আমাদের বিএনপি না জিতলে জিতবে আমাদের আওয়ামী লীগ। কোনো অসুবিধা নাই।’

মিছিল বড় হয় রাজেশের কিন্তু জিতবে আওয়ামী লীগ, এতক্ষণে কথাটার ব্যাখ্যা পরিষ্কার হলো।

হাশেম খান রোডটা নতুন। সেটা সোজা গিয়ে উঠেছে বেড়িবাঁধের রাস্তার সঙ্গে। সেই উঁচু রাস্তার ঢালে একটা বটগাছের নিচে মুরশিদ সরকারের চায়ের দোকান। চা খেতে খেতে তাঁর কথা শুনি। সতর্ক ভাষায় বললেন, ‘ভোটের বাতাস কি আগাম কওন যায়? এখন আহে দক্ষিণা বাতাস, খানিক পরে পাইবেন উত্তইরা বাতাস।’ ভোট কেমন হবে জানতে চাইলে বললেন, ‘দ্যাশে কি আর ভোট আছেনি?’ প্রার্থীরা কেউ কিছু খাওয়ায় না? উত্তর এল, ‘এখন পাবলিকরেই উল্টা খাওয়াইতে অয়। আগে ভোট হইলে আনন্দ ছিল, এখন পাবলিকের মনে আনন্দ নাই।’

পাবলিকের মনে আনন্দ থাকুক বা না থাকুক, ভোটের মাইক গলা ফাটিয়ে বাজাচ্ছে বিজয়ের গান, ‘জিতবে এবার...’

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক
faruk. wasif@prothomalo. com