করোনাভাইরাস: সাবধানতার বিকল্প নেই

চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। ছবি: রয়টার্স
চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। ছবি: রয়টার্স

প্রকৃতির প্রতিশোধ বড়ই নির্মম। তার আক্রোশ পারমাণবিক বোমার ক্ষয়ক্ষতির চেয়ে বিশেষ কম নয়। প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর জুলুম করার ফলে মানুষের সমাজে নতুন নতুন ধরনের বিপদ আসে, যা প্রাথমিকভাবে নিয়ন্ত্রণ কঠিন। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, দাবানলের মতো নতুন রোগের মহামারি বিশ্ববাসীকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। কী কারণে নতুন নতুন ভাইরাসের দ্বারা মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটছে, তা বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বলতে পারবেন। কিন্তু ঘটনা ঘটার পর তা মোকাবিলা করা শুধু চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাজ নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেকের ভূমিকা রাখতে হয়।

মহাজগতে এবং পৃথিবী গ্রহে যেখানে যা-ই ঘটুক, আমাদের গায়ে তাপ না লাগা পর্যন্ত নির্লিপ্ত থাকাই বাঙালির স্বভাব। তারপর বিপদ দোরগোড়ায় এলে শুরু হয় হাহাকার। সে হাহাকার দেখা গেছে তিন বছর আগে চিকুনগুনিয়ার সময় এবং গত বছর ডেঙ্গু যখন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়। সরকারি হিসাবেই দেড় শর বেশি মারা যায়। গণমাধ্যমের হিসাবে দেখা গেছে ২০০-এর মতো। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ডেঙ্গু পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে, তবে আগামী বর্ষার মৌসুমে আবার যে দেখা দেবে না, তা বলা যায় না। সম্মিলিতভাবে দুর্দৈব মোকাবিলার চেয়ে প্রতিদিন গণতন্ত্রের চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধারে আমাদের আগ্রহ বেশি এবং সেই গণতন্ত্রের উদ্ধারকর্মে যদি দু-চার শর মাথা ফাটে, তাতে কারও করুণার উদ্রেক হয় না।

দু-তিন সপ্তাহ ধরে যে খবরটি সারা পৃথিবীতে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে, তা হলো চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে ‘রহস্যজনক’ করোনাভাইরাসজনিত মহামারি। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কয়েক সপ্তাহে মারা গেছে ৫৭ জনের বেশি। যোগাযোগমাধ্যমের ওপর চীনের সরকারের নিয়ন্ত্রণ কঠোর হওয়ায় তাদের দেওয়া তথ্য অনেকের কাছেই সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য নয়।

গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে সংবাদমাধ্যম মুক্ত, সেখানে প্রাকৃতিক হোক, মানবসৃষ্ট হোক, কোনো ঘটনা ঘটলে জানা যায়। চীনের সব ঘটনা পুরোপুরি জানা কঠিন। অমর্ত্য সেন তাঁর দুর্ভিক্ষ বিষয়ে বিখ্যাত গবেষণায় দেখিয়েছেন, বিভিন্ন সময় চীনে দুর্ভিক্ষে কত লোক মারা গেছে, তা বাইরের দুনিয়ার মানুষের কাছে অজানা রয়ে গেছে। তবে পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের পরিস্থিতি এখন নেই। তথ্য সম্পূর্ণ চাপা দেওয়া এখন সম্ভব নয়। তবে সঠিক তথ্য দেরিতে জানলে লাভ নেই। ২০০৩ সালে চীনে সার্স বা সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে আট শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। প্রথম দিকে চীন সরকার তা জানতে দেয়নি।

সপ্তাহখানেক ধরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং আমাদের প্রচারমাধ্যম করোনা মহামারি-সংক্রান্ত যেসব প্রতিবেদন দেখিয়েছে, তা উদ্বেগজনক। দেখা যাচ্ছে, চীনের চিকিৎসকেরাই হিমশিম খাচ্ছেন। হাসপাতালে কয়েক লেয়ারের পোশাক পরে, উন্নত ধরনের মাস্ক ব্যবহার করে তাঁরা আক্রান্ত মানুষকে সেবা দিচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সে অবস্থা মোকাবিলায় দুটি নতুন হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে শুধু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য। একটি হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ১ হাজার ৩০০।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ১০টি দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা গত সপ্তাহ পর্যন্ত ১ হাজার ৩২০। ওই সব দেশের মধ্যে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশ রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। তবে এখনো বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণার মতো পরিস্থিতি হয়নি। নিবিড় সতর্কতা অবলম্বনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

আমাদের সংবাদমাধ্যমে যে প্রতিবেদন দেখা গেছে, তা বেদনাদায়ক এবং অত্যন্ত উদ্বেগের। বাংলাদেশের ২৮০ জনের মতো শিক্ষার্থী ওই নগরীতে অবস্থান করছেন। তাঁদের আতঙ্ক ও কষ্টের সীমা নেই। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কায় তাঁরা ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। খাদ্যসামগ্রী কিনতেও বেরোতে পারছেন না। অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটছে।

উহান শহরের যে মাছের বাজার থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে, তার পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করলেও ছাত্ররা আটকা পড়েছেন হোস্টেলে। তাঁদের পক্ষে চট করে দেশে ফিরে আসাও সম্ভব হচ্ছে না। তাঁদের কষ্ট ও তাঁদের পরিবারের মানুষের উদ্বেগের কথা অনুমান করা যায়। আমাদের প্রার্থনা, তাঁরা সুস্থ থাকুন।

আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও বেনাপোল ও অন্য স্থলবন্দরে থার্মাল স্ক্যানার নেই অথবা থাকলেও অকেজো। সেটাই ভয়ের কারণ। অণুজীববিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাসের উৎপত্তি কোনো বন্য প্রাণী থেকে, পরে আক্রান্ত মানুষ থেকে সুস্থ মানুষে সংক্রমিত হয়। নিউমোনিয়া ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। জ্বর, শ্বাসকষ্ট থেকে দ্রুত অন্যান্য উপসর্গ। প্রাণঘাতী অসুখ হলেও উন্নত চিকিৎসায় প্রাণহানির আশঙ্কা কমানো সম্ভব।

এই নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের হাসপাতালগুলোর নেই। সংক্রামক ব্যাধি যে কাউকে আক্রমণ করতে পারে, কোনো বাছবিচার নেই। গত বছর ডেঙ্গুতে আমাদের কয়েকজন চিকিৎসক এবং নার্স প্রাণ হারিয়েছেন। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য উন্নততর প্রস্তুতি অবিলম্বে গ্রহণ করা প্রয়োজন। রোগটি সম্পর্কে যেহেতু চিকিৎসাবিজ্ঞানীদেরও ধারণা কম, তাই এখনই কঠোর নজরদারি দাবি করে। যুক্তরাজ্যের ল্যানক্যাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা ধারণা করছেন, আগামী ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শুধু উহান শহরেই করোনাভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তির সংখ্যা ১ লাখ ৯০ হাজার পর্যন্ত যেতে পারে।

ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ প্রভৃতি প্রয়োজনে চীনসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে বাংলাদেশিদের যাতায়াত আগের তুলনায় অনেক বেশি। চীনে প্রতি মাসে তিন শতাধিক ব্যবসায়ী যাওয়া-আসা করেন। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে কোনো ছোঁয়াচে ভাইরাস ঢুকে পড়লে তা দ্রুততম সময়ে ব্যাপক ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় শোচনীয় দুর্বলতা। প্রাণঘাতী রোগের ওষুধ দুর্লভ অথবা দুর্মূল্য। জীবন রক্ষাকারী ওষুধ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। তার ওপর নির্মম চিকিৎসা-বাণিজ্য। তা দেখা গেছে এবার ডেঙ্গুর সময়। ডেঙ্গু পরীক্ষার ৫০ টাকার কিট বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকায়। তারপর যখন সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনা মূল্যে দেওয়া শুরু হলো, তখন হতে থাকল কালোবাজারে বিক্রি। প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতির যে সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলেছি, তাতে ভয়াবহ করোনাভাইরাসের রোগীর মতোই স্বাস্থ্য খাতও আক্রান্ত।

দুর্দৈব বলে–কয়ে আসে না। কোনো দেশের সরকারি নেতারা কিরোর মতো ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নন। করোনার মতো আসমানি বালা যে আসছে, তা হিকমতে চীন আগে আঁচ করতে পারেনি। চান্দ্রবর্ষের জন্য চীনারা অপেক্ষায় থাকে। চান্দ্রবর্ষে আনন্দ-উল্লাসে মাতে। এবার তাদের সে গুড়ে বালি।
নির্যাতিত রোহিঙ্গারা নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে বিপন্ন, চীনারা নিজেদের ঘরের মধ্যেই বিপন্ন।

বাংলাদেশ থেকে চীন বেশি দূরে নয়। চীন, থাইল্যান্ড, হংকং থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ বাংলাদেশে আসছে। কার মাধ্যমে এই ভাইরাস প্রবেশ করবে, কেউ জানে না। কার ফুসফুসে ঢুকে পড়বে, তা-ও বলা যায় না। টাকা থাকলেই যে বাঁচা যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। অন্য রোগীর জন্য পাওয়া
গেলেও প্রাণঘাতী ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের রোগীর জন্য যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাবে, সে ভরসা কম। সব দেশের মানুষেরই আত্মরক্ষা আগে, অন্যকে সেবাদান পরে।

রোগজীবাণু ও ভাইরাস ব্যাংকের টাকার মতোই অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ। দলনিরপেক্ষ তো বটেই। তারা স্বাচিপ বা ড্যাব বোঝে না। এ ধরনের সম্ভাব্য দুর্যোগ প্রতিরোধ করা শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে সম্ভব নয়। বিভিন্ন এজেন্সির সমন্বিত শক্তিশালী টাস্কফোর্স দরকার। বেশি দরকার যোগ্য-দক্ষ মানুষের। যোগ্যতা বিশেষ দলীয় লোকদের গায়ে লেখা থাকে না। রোগবালাই-মৃত্যু কোনো দলীয় বিষয় নয়, সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিষয় তো নয়ই। সাবধানতার বিকল্প নেই। অবিলম্বে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সেটাই প্রত্যাশা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক