বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স: এত দিন চলল কী করে

সবাই সবকিছু জানতেন। বিজ্ঞদের চোখের সামনেই প্রায় দেড় যুগ ধরে চলছিল সান্ধ্য কোর্স—উচ্চশিক্ষার সর্বনাশের মহা আয়োজন। মাঝেমধ্যে মৃদু প্রতিবাদ করেছে বাম ছাত্রসংগঠনগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ নিচু স্বরে সমালোচনা করলেও বড় অংশই ছিলেন সান্ধ্য কোর্সের পক্ষে। অনেকের কাছে এটা বাড়তি উপার্জনের উপায়।

গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সান্ধ্য কোর্সের কড়া সমালোচনা করেছিলেন রাষ্ট্রপতি ও আচার্য মো. আবদুল হামিদ। এরপর এগিয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), যে প্রতিষ্ঠানটিকে দমিত করে রেখেছে আমলাতন্ত্র। ইউজিসি নরম ভাষায় বলেছে, সান্ধ্য কোর্স পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে বিধায় তা বন্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন উপাচার্য এ বিষয়ে তাঁদের অবস্থান জানান। অন্তত চারজন উপাচার্য বলেছেন, তাঁরা সান্ধ্য কোর্সের পক্ষে নন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমান এক দিনের মাথায় ঘোষণা দেন, রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনুযায়ী ও ইউজিসির পরামর্শে নতুন করে কাউকে এই কোর্সে ভর্তি করা হবে না। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এই কোর্স বন্ধের ঘোষণা দেয়।

স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এই কোর্স নিয়ে ইউজিসির পরামর্শ পর্যালোচনায় কমিটি করে। আর এই কমিটির মধ্যেই আটকে আছে সবকিছু। প্রথম আলো ২২ জানুয়ারি থেকে চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্সের যে হালচাল তুলে ধরে তাতে দেখা যায়, রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পর বিষয়টি পর্যালোচনায় নামকাওয়াস্তে কমিটি করেছে সব বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে তিনি কমিটি করে দিয়েছেন। এক মাসের মধ্যে ওই কমিটির সুপারিশ পেয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। ইতিমধ্যে আট সপ্তাহ পার হয়েছে। প্রতিবেদন হাতে পাননি উপাচার্য।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলাম বলেছিলেন, সব সময়ই তাঁর অবস্থান সন্ধ্যাকালীন কোর্সের বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রথম আলোয় প্রকাশিত ২৫ জানুয়ারির প্রতিবেদনে তাঁর সহ-উপাচার্য আমির হোসেন অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে বলেছেন, তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘উইকেন্ড কোর্স’ চালু আছে। তাই এটি বন্ধের বিষয়ে ভাবছেন না। অথচ নাম ভিন্ন হলেও কোর্সের ধরন কিন্তু একই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি কমিটি করেছে। প্রতিবেদন পায়নি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য আনন্দ কুমার সাহা প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, তিনি সান্ধ্য কোর্সের বিপক্ষে। তাঁকেই প্রধান করে ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ ২২ জানুয়ারি তিনি এ বিষয়ে চিঠি পান। এক মাস লাগল তদন্ত কমিটির কাছে চিঠি পৌঁছাতে! ওই বিশ্ববিদ্যালয় এখনো নতুন করে সান্ধ্য কোর্স খুলছে।

রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পর যে ঝড় উঠেছিল, তা ঝিমিয়ে পড়েছে। আর দশটি ঘটনার মতোই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কমিটি হয়েছে, প্রতিবেদন কবে হবে, কেউ জানে না। প্রতিবেদন পাওয়ার পর কী হবে, তা-ও অনিশ্চিত।

বেসরকারি ১০-১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ও দূরশিক্ষণ চালুর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সনদ কেনাবেচা করেছিল। ২০১০ সালে আইন সংশোধন করে এবং কয়েক বছরের নানামুখী চেষ্টায় সেটা বন্ধ হয়। স্বায়ত্তশাসিত ও বড় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স চালুর ধরন দেখে মনে হয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গাটি তারা দখল করেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ও লোগো থাকায় ওজনটা বেশি, টাকাও লাগে বেশি। উপাচার্য থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট কোর্সের সব শিক্ষক এবং কর্মচারীরা সম্মানী পান। তাই রাতারাতি এই উপার্জন প্রক্রিয়া বন্ধ করা বেশ কঠিন।

মূল প্রশ্ন হলো সবাই আগে থেকে জানলে ও বুঝলে এটা এত দিন এসব চলল এবং দিন দিন বাড়ল কীভাবে? যেকোনো কোর্স অনুমোদনের জন্য ইউজিসির অনুমোদন বাধ্যতামূলক। তা যে নেওয়া হয়নি, তা ইউজিসির বক্তব্যেই স্পষ্ট। এই অন্যায়ের দায় কার, শাস্তি কাদের প্রাপ্য? এর দায় এড়াতে পারে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এমনকি ইউজিসিও।

চোখ বন্ধ করে বলা যায়, সান্ধ্য কোর্সের নামে যা কিছু হয়েছে, তার প্রথম দায় একজন উপাচার্যের। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন একাডেমিক লিডার ও প্রশাসনের প্রধান। সিনেট, সিন্ডিকেট বা রিজেন্ট বোর্ড, একাডেমিক কমিটি—যা কিছু থাকুক না কেন, উপাচার্যই তো সর্বেসর্বা। সরাসরি সরকারি দল থেকে, অথবা সরকারি দলের সমর্থক শিক্ষক সংগঠনের নেতা হয়ে উপাচার্য পদে আসীন শিক্ষকদের প্রায় সবাই গোটা বিশ্ববিদ্যালয় কবজা করে ফেলেন। তিনি চাইলে সান্ধ্য কোর্স থাকবে না—এটাই বিশ্বাসযোগ্য। উপাচার্যদের পর সান্ধ্য কোর্স নিয়ে দায় আসে ছাত্রসংগঠনগুলোর ওপর। বাম কয়েকটি ছাত্রসংগঠন বিভিন্ন সময় তাদের শক্তি ও সামর্থ্য অনুযায়ী এই কোর্স বন্ধের কথা বলেছে। কিন্তু ক্যাম্পাসের মূল শক্তি ছাত্রলীগ ও ছাত্রদল এ বিষয়ে জোরালো কিছু বলেছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই।

সান্ধ্য কোর্স চালু করার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল—যাঁরা দিনের বেলায় নানা কারণে ক্লাস করতে পারেন না, তাঁরা যাতে এসব কোর্সে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও বিষয়টিকে সেভাবেই দেখেছিল। এখনকার মতো ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে ওই কোর্স শুরু হয়নি। এখনকার অবস্থাটা ফেলো কড়ি, মাখো তেল।

পাঁচ বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগে সান্ধ্য কোর্সের ফি ছিল ৪০ হাজার টাকা, ৫ বছরের মাথায় তা বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত কোর্সের দ্বিগুণ বা তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে সান্ধ্য কোর্সে, যেখানে ক্লাস, পরীক্ষা, খাতা দেখা—সবকিছুতেই ঢিলেঢালা অবস্থা। অভিযোগ আছে সান্ধ্য কোর্স অনেক শিক্ষকের কাছে তা নিয়মিত কোর্সের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যিনি যত বেশি কোর্স নেবেন, তত বেশি লাভবান হবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনিতেই গবেষণা খুবই কম। সান্ধ্য কোর্স শিক্ষকদের আরও বেশি গবেষণাবিমুখ করেছে—এমন পর্যবেক্ষণ জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, সান্ধ্য কোর্সের ক্লাস এবং তার মধ্যে আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়া। এসব করার পর গবেষণা বা পড়াশোনার সুযোগ কোথায়?

সান্ধ্য কোর্স বন্ধের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ধ্বংসের লাগাম টেনে ধরতে রাষ্ট্রপতির বক্তব্য প্রশংসিত হয়েছে। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আচার্য ডাকসু নির্বাচনের কথা বলেছিলেন, যেকোনোভাবে হোক একটি নির্বাচন হয়েছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয় যদিও ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে পারেনি।

এখন আচার্য হিসেবে আরও কিছু ভূমিকা তাঁর কাছে প্রত্যাশিত। সমন্বিত ভর্তি নিয়ে রাষ্ট্রপতি কথা তুলেছিলেন বছর দুয়েক আগে। হবে, হচ্ছে করেও তা হয়নি। দেশের প্রায় ১৫০টি সরকারি, বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় সামাল দেওয়ার সক্ষমতা ইউজিসির নেই। এটাকে শক্তিশালী করতেই হবে। উচ্চশিক্ষা কমিশন করার কথা হচ্ছে বছরের পর বছর। অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলও এক যুগ ধরে আলোচিত বিষয়, এর কার্যকারিতাও দেখা যায়নি। বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য বা কোষাধ্যক্ষের পদ খালি থাকে বছরের পর বছর, তাঁদের কিন্তু নিয়োগ দেন আচার্য।

আচার্য হিসেবে উচ্চিশক্ষার এসব বিষয় দেখভালের দায়িত্ব কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতির ওপরই বর্তায়। প্রয়োজনে নির্দেশ বা চাপ দিন এবং না শুনলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিন।

তবে একটি বিষয় বেশ লক্ষণীয়। আচার্য যখনই বললেন সান্ধ্য কোর্স খারাপ, তখনই উপাচার্যরা একযোগে বলতে শুরু করলেন, এটা তাঁদেরও পছন্দ ছিল না।

এখানে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাহেব ও মোসাহেব’ কবিতাটি প্রাসঙ্গিক মনে হয়।

কবিতার প্রথম অনুচ্ছেদ ছিল—সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!”/মোসাহেব বলে, “চমৎকার! সে হতেই হবে যে!/হুজুরের মতে
অমত কার?”

শরিফুজ্জামান: প্রথম আলোর রিপোর্টিং বিভাগের প্রধান