আশ্রয়ণ প্রকল্প ছেড়ে যায় কেন ঘরহীনেরা?

গত এক দশকে নদী ভাঙনে ৬৮ লাখ মানুষ ভিটে ছাড়া হয়েছে। জানিয়েছে সুইডেনভিত্তিক রাউলওয়ালবার্গ ইনস্টিটিউট ও ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়। তার মধ্যে ১৩ লাখ ৪২ হাজার মানুষ ২০১০ সালের আইলাতেই ঘরহীন হয়েছে। চলতি বছরের খানা আয়-ব্যয় জরিপ ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা জানিয়েছে, প্রায় ৫০ লাখ মানুষের বাড়িঘর নেই। ২০১১ সালের তথ্যমতে, ৩৩ ভাগ পরিবার একটি ঘরে ঘুমায়। তবে গ্রামে গৃহহীন মানুষ চোখে পড়ে না। অন্যের জমিতে বা চরের খাসজমিতে ঘর তুলে থাকা মানুষ বিস্তর।

গত ১৩ অক্টোবর ১০০টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে। এর আগে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরেও দেশব্যাপী কিছু আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাড়ি তৈরি হয়। আশ্রয়কেন্দ্র আর আশ্রয়ণ প্রকল্পের মধ্যে ভেদ আছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো মূলত সাইক্লোন ও বন্যা শেল্টার। যেখানে মানুষ দুর্যোগের সময় আশ্রয় নেন। আর আশ্রয়ণ প্রকল্প হচ্ছে স্থায়ী আবাস। কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার তিনটি চরে মোট ১১টি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ভিটা আছে। তার মধ্যে চিলমারী ইউনিয়নে ছয়টি, নয়ারহাটে চারটি ও রানীগঞ্জে একটি। পুরোনোগুলোতে ৪০টি পরিবার থাকার ব্যবস্থা ছিল। পরেরগুলোতে ১২০ ও ১৪০টি করে পরিবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১৯৯৮-৯৯ সালের গুলোতে বাসিন্দারা প্রকল্পের ঘর কটি ভেঙে ফেলেছেন। কাঠ, টিনগুলো সমানভাবে ভাগ করে নিয়ে ওই ভিটাতেই আলাদা করে বাড়ি তুলেছেন। প্রকল্পের পুকুরে ৪০ পরিবার যৌথভাবে মাছ ছাড়ছে ও ভোগ করছে। এই পুকুরগুলো তৈরি হয়েছিল প্রকল্পের ভিটা উঁচু করতে গিয়েই। কিন্তু পরের ভিটাগুলো ড্রেজার দিয়ে ভরাট করায় পুকুর তৈরি হয়নি। ব্রহ্মপুত্র থেকে বালু এনে ভরাট করায় পুকুর হয়নি। ৭০ শতাংশ পরিবার দরজা-জানালা-বেড়া খুলে নিয়ে চলে গেছে। সে কারণে বাকি ৩০ ভাগ একটু শ্বাস নিয়ে থাকতে পারছে। কথা হচ্ছে, পুরোনো আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ভেঙে বাড়ি বানানোই বা কেন কিংবা ওই ৭০ শতাংশ পরিবার কেন ছেড়ে চলে গেল?

২.
পরিবার বলতে শুধু স্বামী-স্ত্রী নয়। দাদা-দাদি, বাবা-মা ও ভাই-বোন মিলে পরিবার। অন্তত গ্রামের পরিবার। ছয় সদস্যের একটি পরিবার ২৭ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৯ ফুট প্রস্থের একটি ঘরে থাকা, খাওয়া ও রান্না করা কি সম্ভব? বরাদ্দ করা একেকটি ঘর টিনের বেড়া দিয়ে আলাদা করা। শাখাহাতী চরে পুরোনো-নতুন মিলে তিনটি আশ্রয়ণ প্রকল্প আছে। সেখানকার বাসিন্দা আবদার (৭০), ছামাদ (৬৭), লুৎফর (৫০), নেজাবুদ্দিন (১১৫) বলেন, ‘ঘরের এ মাথায় পাদলে ওমাথা পর্যন্ত শোনা যায় রাতের বেলা। কোনো ছাওয়া কাইন্দলে আর কারও ঘুম হয় না। স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয়তা রক্ষা করা অসম্ভব।’

ঘরগুলো মুখোমুখি। মধ্যখানে ৮ ফুট প্রায়। শিশুদের খেলার জায়গা নেই। দুটি মাত্র জানালা। ঘরের ভেতর আলো ঢুকতে পারলেও বায়ু যাতায়াতের ব্যবস্থা নেই। ১০-২০ ঘর মিলে এক-দুইটা টয়লেট ও টিউবওয়েল। পুকুর থাকলে স্নানের সুযোগ থাকত। সামনে এমন উন্মুক্ত দৃশ্যাবলি নেই, যা বারান্দায় বসে উপভোগ করতে পারে। ঘরগুলো আবদ্ধ গোয়ালঘরের মতো। আশ্রিত সাহেরা বেগম। স্বামী, শ্বাশুড়ি, তিন সন্তান মিলে ছয়জনের সংসার। তিনি থাকেন শাখাহাতী চরের একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পে। পরিবার একটি হলেও তিনটি ঘর নিয়ে থাকেন। বাকি দুই ঘর ছিল যাদের, তারা ছেড়ে চলে গেছে। ফলে থাকতে পারছেন। তিনি বলেন, ‘জায়গাটা বড় আঁটো (সংকীর্ণ) বাহে। একটা ঘর নিয়া থাকা যায় না।’

গ্রামের মানুষ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে পাটখড়ি, ধনচে, পোয়াল, গাছের ডাল ও পাতা, কাঠ, বাঁশ, গোবরের ঘুঁটা, ধানের গুঁড়া। প্রতিটি উপকরণই ধোঁয়া সৃষ্টিকারী। একই কক্ষের ভেতর যখন রান্নাঘর থাকে, তখন ধোঁয়াজনিত রোগ দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। এ কারণে মাথাব্যথা, হাঁপানি, সর্দি, কাশি, চোখের সমস্যা, গ্যাস্ট্রিক, বদহজম ও জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার হার উদ্বেগজনক।

আশ্রিত পরিবারটি ভূমিহীন হলেও চাষি বা আধিয়ার হওয়া স্বাভাবিক। তাহলে খড় শুকানো ও স্তূপ করা, জ্বালানি জমিয়ে রাখা স্বাভাবিক। কিংবা জ্বালানির জন্য সংগৃহীত লতাপাতা রাখার জায়গাও তো চাই। কয়েকটি মুরগি, হাঁস কিংবা গরু-ছাগল-ভেড়া তো হেসেখেলে বড় হতে পারে। কিন্তু তা রাখার জন্য জায়গা? তা নাই বলে সারা দিন ঝগড়ার আওয়াজ কানে আসবে। সারা দিন কোনো না কোনো পরিবারের ঝগড়া লেগেই আছে। শিশুর বিকাশ ও পড়ালেখার পরিস্থিতি কেমন, তা নিশ্চয়ই বুঝতে বাকি নেই।

শহুরে শ্রমজীবীদের কাছে ঘরবাড়ি বলে কিছু নেই। ঘুম আর আহার মাত্র। সারা দিন বাইরে শ্রম বিক্রি করে রাতে ঘরে ফিরে পেটে দুটো দানা দিয়েই চোখ বন্ধ করা। সারা দিন অপরের জন্য খাটা। কিন্তু গ্রামে বাড়ি মানে উৎপাদনকেন্দ্র। বাড়ি মানে বাগান। বাড়ি মানে হাঁস-মুরগি আর গরু-ছাগলের ডাক। বাড়ি মানে বাঁশ-বেত-তাঁতের শিল্পকেন্দ্র। স্বামী খেতে গেলে বউ কাঁথা ও জাল কিংবা বাঁশ-বেতের ঝুঁড়ি বুনতে বসেন। কিন্তু বাড়ির পরিবেশের কারণেই আশ্রিত নারীদের কর্মহীন থাকা ছাড়া পথ থাকে না। বাড়তি রোজগার না থাকায় শুধু আশ্রয়টুকুর জন্য প্রকল্পের ঘরে থাকার মানে নেই। তবে হ্যাঁ, এখানকার নারীদের যদি তাঁতসহ অন্যান্য কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়, যদি এখানে তাঁতের মাকু বসানোর ব্যবস্থা করা যায় এবং সেগুলো বিপণনের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে এটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। মানে বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা গেলে সম্ভব। নইলে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের অভিশপ্ত মানুষ মনে হবে নিজেদের। কবি বিজয় গুপ্তের ভাষায়, মলয়া শীতল বায়/কোকিলা পঞ্চম গায়/ভ্রমরের শব্দ বহুতর।/এসব অপূর্ব রীত,/শোভা চারিভিত। আশ্রিতদের যদি মানুষ মনে রাখি, তাহলে এমনটাই করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাড়ি মানে শুধু কাঠ-টিনের ঘর নয়, নিশ্চিত ঠিকানাও। কিন্তু প্রকল্পের এসব খোপে গরুও তো থাকবে না। আর মানুষ? নৈবচ নৈবচ।

লেখক: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি।
nahidknowledge@gmail. com