পোস্টারের অত্যাচার, শব্দদূষণ ও দো-আঁশলা ভোট

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা এখন শেষ মুহূর্তের দৌড়ঝাঁপ করছেন। আর দুই দিন পরই ভোট। ৩০ জানুয়ারি মধ্য রাতের পর আনুষ্ঠানিক প্রচার বন্ধ হয়ে যাবে। মঙ্গলবার পর্যন্ত আওয়ামী লীগের একজন ও বিএনপির দুই মেয়র প্রার্থী ইশতেহার প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগের অপর মেয়র প্রার্থীর বুধবার ইশতেহার প্রকাশ করার কথা আছে।

বাংলাদেশে সবকিছুই চলে উল্টো নিয়মে। পৃথিবীর সব দেশে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হওয়ার পরই প্রার্থীরা ইশতেহার প্রকাশ করেন, যাতে নির্বাচিত হলে আগামী পাঁচ বছরে কী করবেন, নগরবাসীকে কী কী সেবা দেবেন, সেসব লেখা থাকে। এরপর সেই ইশতেহার নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হবে, ভোটাররা ইশতেহার নিয়ে মতামত জানাবেন। তাঁদের কোনো প্রশ্ন থাকলে প্রার্থীরা তার জবাব বা ব্যাখ্যা দেবেন।

কিন্তু আমাদের মেয়র প্রার্থীরা শেষ মুহূর্তে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে নিয়ম রক্ষা করলেন শুধু। জনগণের মুখোমুখি হলেন না। এক মাস ধরে তাঁরা কথা বলে গেছেন। জনগণকে কোনো কথা বলতে দেননি। জনগণের কোনো কথা তাঁরা শোনেননি। সে রকম কোনো ফোরামও তারা তৈরি করেননি। নির্বাচনের আগে ‘জনতার মুখোমুখি’ নামে একটি অনুষ্ঠান খুব জনপ্রিয় ছিল। তখন প্রার্থীরা জবাবদিহি করতেন। এখন আর জবাবদিহি করতে চান না। যেকোনো উপায়ে একবার নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে পারলে আর পায় কে? পাঁচ বছরের জন্য জমিদারি নিশ্চিত।

আন্তর্জাতিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা শহর বায়দূষণে চ্যাম্পিয়ন। এখন জরিপ করলে শব্দদূষণেও চ্যাম্পিয়ন হবে। ঢাকা শহরে কয়েক লাখ এসএসসি পরীক্ষার্থী। তাদের অসুবিধার কথা কেউ ভাবছেন না। সকাল থেকে পাড়ায় পাড়ায় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর অনুসারীরা বিকট শব্দে মাইক বাজিয়ে চলেছেন। মিছিল করছেন, স্লোগান দিচ্ছেন। কথায় বলে, আমরা সবাই রাজা এই ভোটের রাজত্বে।

সোমবার রাতে মগবাজার থেকে শান্তিনগর যাচ্ছিলাম রিকশাযোগে। রিকশাচালকের বাড়ি পটুয়াখালী। জিজ্ঞেস করলাম, ভোট কেমন হবে বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ভোট ভালো হবে। কী করে বুঝলেন ভোট ভালো হবে? তাঁর সোজা উত্তর, নির্বাচনে তো অনেকগুলো দল অংশ নিয়েছে। এক দল হলে নির্বাচনটি খারাপ হতো। এখন সমানে সমানে লড়াই হবে। তাঁর কাছে জানতে চাই, গত জাতীয় নির্বাচনেও তো সব দল অংশ নিয়েছিল, সেই নির্বাচনে কী সমানে সমান লড়াই হয়েছিল? তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনীতি কী বুঝি না। আমাদের জন্য নির্বাচন হলেও যা, না হলেও। আমাদের গরিবের কথা কেউ ভাবে না।’

কারওয়ান বাজারের এক ফল দোকানির সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলাপ করলে তিনিও নিরাসক্ত কণ্ঠে বলেন, ‘ভোট দিয়ে আমরা কী করব? ভোট তো বড় লোকদের ব্যাপার। ভোটের আগে গরিবদের কদর থাকলেও ভোটের পর কেউ জিজ্ঞেস করে না।’ তবে তিনি যে কথাটি বলেননি তা হলো এখন ভোটের আগেও ভোটারদের কথা কেউ ভাবে না। তিনি বললেন, ভোট নিয়ে বেশি কথা বলা যাবে না। ভোটের পরও তো এখানে দোকান চালাতে হবে।

এই ভয় শুধু কারওয়ান বাজারের দোকানির নয়। বলা যায় গোটা শহরেই নির্বাচন নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় একধরনের আতঙ্ক ও চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এত দিন জেনে এসেছি, নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা বিনীত থাকবেন। ভোটারদের কাছে নম্রকণ্ঠে ভোট চাইবেন। কিন্তু এখনকার প্রার্থীরা অনেক বেশি বুদ্ধিমান। তাঁরা ভাবেন, নির্বাচনের আগে নরম হলে ভোটাররা পেয়ে বসবেন। তাই আগে থেকেই তাঁদের ভয় পাইয়ে দিতে হবে। এ রকম একটি ভয় পাইয়ে দেওয়ার ঘটনা জানতে পারি শাহজাহানপুর থানায় পেশ করা একটি এফআইআর-এ। সেখানে হুমকিদাতা ও হুমকি প্রাপক দুজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। হুমকিপ্রাপ্ত ব্যক্তি শাহজাহানপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাহাঙ্গীর হায়দার চৌধুরী। আর হুমকি দিয়েছেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগেরই বিদ্রোহী প্রার্থী মামুনুর রশীদের অনুসারীরা।

থানায় পেশ করা অভিযোগে বলা হয়, ‘আমার বাড়ির পাশে একটি নির্বাচনী ক্যাম্প করা হয়েছে। ১২ নম্বর ওয়ার্ডে লাটিম প্রতীকধারী কাউন্সিল প্রার্থীর ১৫–২০ জন সমর্থক ২৭ জানুয়ারি রাত ১২টা ১৫ মিনিটে তাঁর বাড়ির ভেতরে কাঁদি ভরা কলাগাছে পোস্টার লাগাতে গেলে তিনি বাধা দেন। কেননা ফলবান কলাগাছে পোস্টার লাগালে গাছ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এরপর ওই ব্যক্তিরা তাঁকে ভয়ভীতি দেখান এবং মেরে ফেলার হুমকি দেন। প্রার্থীর সমর্থকেরা উচ্চ স্বরে কথা বলতে থাকলে জাহাঙ্গীর চৌধুরী তাঁদের বলেন, এখানে এসএসসি পরীক্ষার্থী আছে। অতএব তাঁরা যেন আস্তে কথা বলেন। কিন্তু লাটিম প্রতীকধারী প্রার্থীর সমর্থকদের এক কথা—তাঁরা জোরে কথা বলবেনই, পরীক্ষার সময়ে কেন নির্বাচন দিল?

অর্থাৎ মাঝরাতে ঘরে বসে পরীক্ষার্থীর পড়ার চেয়ে কাউন্সিলর প্রার্থীর পক্ষে প্রচার অনেক বেশি জরুরি। প্রায় সব ওয়ার্ডের চিত্র কমবেশি একই রকম। বিশেষ করে যেসব ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন। দল ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দিলেও প্রতীক দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা এই নির্বাচনকে বলেছেন দো-আঁশলা। আধেক দলীয় আধেক নির্দলীয়। অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্বাচনের সময় নেতৃত্ব বিদ্রোহী প্রার্থী সম্পর্কে যত কড়া কথাই বলুন না কেন, জয়ী হলে তাঁকেই কোলে তুলে নেন। ফলে বিদ্রোহী প্রার্থীরা বেশি করে জবরদস্তি চালান। এটি শুধু সিটি করপোরেশন নয়, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ সব স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনেও ঘটেছে।

তবে সত্যিকার জয়–পরাজয় নির্ধারণের জন্য যে নির্বাচনটি সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু তারা কানে তুলো ও নাকে ঠুলি দিয়ে বসে আছে। নির্বাচন প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে আচরণবিধি ভঙ্গের অসংখ্য অভিযোগ এলেও তারা একটিরও সুরাহা করতে পারেনি। গবেষক-লেখক মহিউদ্দিন আহমদের নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে মন্তব্যটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে প্রয়োজন সদিচ্ছা ও মেরুদণ্ড। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কেউ মেরুদণ্ডের শক্তির প্রমাণ রাখতে পারেনি। রকিব কমিশনের একজন সদস্য টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে মেরুদণ্ড প্রদর্শন করে হাসির পাত্র হয়েছিলেন। বর্তমান কমিশনের কারবার দেখে মানুষ হাসতেও ভুলে গেছেন।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com