নিদ্রা-রহস্য ও একজন নিদ্রা চিকিৎসক

শিল্পী পাবলো পিকাসোর বিখ্যাত স্বপ্ন নামের চিত্রকর্ম।
শিল্পী পাবলো পিকাসোর বিখ্যাত স্বপ্ন নামের চিত্রকর্ম।

৫০ বছর বয়সে, ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসের এক বিকেলে পাবলো পিকাসো দারুণ এক ছবি এঁকে ফেলেন। ছবিটি তাঁর বাইশ বছর বয়সী বান্ধবীর। সে চেয়ারে বসে মাথা একদিকে হেলিয়ে ঘুমাচ্ছে। হয়তো ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, কারণ, ছবির নাম Le Rêve (স্বপ্ন)। অবশ্য নিদ্রিত বান্ধবীর ছবিতে পিকাসো কৌশলে একটি কামোদ্দীপক উপাদানও লুকিয়ে রেখেছেন, যা এই ছবিতে শিল্প-সমালোচকদের প্রচুর আগ্রহ সৃষ্টি করে। ছবিটি ১৯৪১ সালে ৭০০০ মার্কিন ডলারে বিক্রি হয়েছিল। নানা হাত বদলের পর ২০১৩ সালে এক মার্কিন ধনকুবের ছবিটি কিনেছেন সাড়ে পনেরো কোটি মার্কিন ডলারে!

তবে বর্তমান লেখার বিষয়বস্তু পিকাসোর সেই ঘুমের ছবি নয়। লেখার বিষয়বস্তু খোদ ঘুম বা নিদ্রা।


যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের জেলিকো শহরে ‘কবির লেন’ নামে একটি রাস্তা আছে। রাস্তাটি একজন বাংলাদেশি ডাক্তারের নামে! তাঁর নাম হুমায়ুন কবির। ২৫ বছর যাবৎ তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তারি করেন। তিনি নিদ্রা-চিকিৎসাসহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের চারটি শাখায় আমেরিকান বোর্ড সার্টিফায়েড। জেলিকো শহরে আপালোচিয়ান স্লিপ ডিজঅর্ডার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকেও কাজ করেন।

সেদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এক আড্ডায় এসেছিলেন সেই নিদ্রা-বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন কবির। তিনি ঘুম সম্পর্কে যা শোনালেন তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সে রাত্রে আমার ঘুমই হলো না! ঘুম সম্পর্কে সর্বশেষ নানা গবেষণা-তথ্য ও তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে খুব আকর্ষণীয়ভাবে বললেন তিনি। তাঁর লেখা ‘ঘুম নিয়ে কিছু কথা’ সম্ভবত বাংলা ভাষায় ঘুম বিষয়ে একমাত্র বই। আলোচনার শুরুতে তিনি স্লাইডে পিকাসোর পূর্বোক্ত Le Rêve ছবিটি দেখিয়েছিলেন।


সেই আদিকাল থেকে মানুষ ঘুমকে বোঝার চেষ্টা করেছে। ঘুম ও স্বপ্ন নিয়ে প্রাচীন মিসরীয় ও সুমেরীয়দের যে চিন্তাভাবনা ছিল তার প্রমাণ আছে। হিপোক্রেটিস ঘুম নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি সৌরজগতের সঙ্গে ঘুমের সম্পর্ক নিয়ে ভেবেছেন। ডাক্তার হুমায়ুন কবিরও জানালেন যে ঘুমের সঙ্গে সূর্যালোকের একটা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। রাত-দিন, আলো-আঁধারিই মানুষের নিদ্রা-চক্র নিয়ন্ত্রণ করে।

ঘুমের নানা স্তর আছে। একজন সুস্থ লোক বিছানায় যাওয়ার ১০ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। এটি ঘুমের প্রথম স্তর। এই স্তরের ঘুম হালকা। দ্বিতীয় স্তরের ঘুম আরেকটু গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী। তৃতীয় স্তরে আসে ক্লান্তিনাশক গভীর ঘুম। এরপরের স্তরের ঘুমের সময় শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবশ হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু মস্তিষ্ক যেন হঠাৎ জেগে ওঠে! এ সময় কেবল চোখগুলো দ্রুত নড়তে থাকে। এ জন্য এই ঘুমের নাম Rapid Eye Movement বা ‘দ্রুত চোখ নাড়া’ পর্বের ঘুম, ডাক্তার কবির সংক্ষেপ করে বলেন, ‘দ্রুচোনা’ ঘুম। এই দ্রুচোনা ঘুমের সময়ই মানুষ স্বপ্ন দেখে। এই পর্বের ঘুমের পর আবার হালকা ঘুমের মধ্য দিয়ে মানুষের নিদ্রাচক্র সমাপ্ত হয়।

পৃথিবীর প্রতিটি জীবকেই ঘুমাতে হয়। তা সে হাতি হোক, মাছি হোক আর এককোষী অ্যামিবাই হোক। কেউ টানা ঘুমায়। কেউ থেমে থেমে ঘুমায়। কুকুর ১৫ মিনিট ঘুমানোর পর ৫ মিনিট জেগে থাকে, আবার ঘুমায়। ডলফিন সাঁতার কাটতে কাটতে ঘুমায়। তখন তার মস্তিষ্কের এক অংশ ঘুমন্ত ও অন্য অংশ জেগে থাকে। কোনো কোনো পাখি উড়ে উড়ে ঘুমায়।

একটি গবেষণায় কয়েকটি ইঁদুরকে কিছুতেই ঘুমাতে দেওয়া হচ্ছিল না। এমন ব্যবস্থা করা ছিল যে ইঁদুরের ঘুম পেলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেগুলোকে জাগিয়ে দেওয়া হবে। না ঘুমাতে পেরে ইঁদুরগুলো অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে এবং ১১ দিন থেকে একে একে মরতে শুরু করে। ৩১ দিনের মধ্যে সব ইঁদুর মারা যায়। ইঁদুরের যেমন, তেমনি মানুষসহ সব প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য ঘুম অপিহার্য।

সব মানুষের চব্বিশ ঘণ্টায় আট ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। ঘুম কম হলে মানুষের বুদ্ধিমত্তার ওপর তার প্রভাব পড়ে, দ্রুত বা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা হ্রাস পায়। অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে নানা বিপত্তি ঘটতে পারে। চেরনোবিল পারমাণবিক প্ল্যান্টে কর্মরত প্রকৌশলীরা পারমাণবিক দুর্ঘটনার আগের দিন একটানা ১৩ ঘণ্টা কাজ করার পর সামান্য ঘুমিয়েই পরদিন আবার কাজে এসেছিলেন। মহাশূন্য শাটল চ্যালেঞ্জার দুর্ঘটনার পর জানা গিয়েছিল যে ম্যানেজারদের কেউ কেউ আগের রাতে মাত্র দুঘণ্টা ঘুমিয়েছিলেন। চালকের ঘুম কম হওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বছরে প্রায় এক লাখ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, আর মারা যায় প্রায় ২৪ হাজার লোক। বাস-ট্রাক ড্রাইভারদের ঘুমের কারণে আমাদের দেশে কতজন সড়ক দুর্ঘটনার বলি হচ্ছে, তার পরিসংখ্যান আমরা কবে পাব?

নতুন কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে ছয় ঘণ্টার কম ঘুমায়, তারা যারা পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমায় তাদের চেয়ে কম বাঁচে। আবার দিনে নয় ঘণ্টার বেশি ঘুমও মৃত্যু ত্বরান্বরিত করতে পারে। আমাদের সবার শরীরে ‘ন্যাচারাল কিলার সেল’ নামের কিছু ক্যানসার প্রতিষেধক সেল আছে। গবেষণায় নাকি এমনও আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে দিনে চার ঘণ্টার কম ঘুমালে এই ‘ন্যাচারাল কিলার সেল’–এর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়। এর ফলে মানবদেহে ক্যানসারের সম্ভাবনা বাড়ে। এ ছাড়া ঘুমের ঘাটতির জন্য শরীরের ডিএনএতে পরিবর্তন ঘটে গিয়ে ভবিষ্যৎ বংশধরদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

পঞ্চাশের দশকে মানুষ গড়ে সাত ঘণ্ট ঘুমাত। এখন ঘুমায় সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা। কম্পিউটার, ট্যাব, মোবাইলের নীল আলোই জাগিয়ে রাখছে মানুষকে। এই কম ঘুমের কারণে নানা সমস্যাও দেখা দিতে শুরু করেছে। যেমন গবেষণায় দেখা গেছে যেসব শিক্ষার্থী টেলিভিশন, ভিডিও গেম বা মোবাইল আসক্তির জন্য রাতে কম ঘুমাচ্ছে, পরীক্ষায় তারা খারাপ গ্রেড পাচ্ছে। ঘুম চোখে স্কুলে যাওয়া শিশুরা গণিতে খারাপ করছে।


ডা. হুমায়ুন কবীর, যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের জেলিকো শহরে ‘কবির লেন’ নামে একটি রাস্তা আছে। রাস্তাটি এই ঘুম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নামে।
ডা. হুমায়ুন কবীর, যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের জেলিকো শহরে ‘কবির লেন’ নামে একটি রাস্তা আছে। রাস্তাটি এই ঘুম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নামে।

আমরা ঘড়ি ধরে চলি বা না চলি, আমাদের শরীর কিন্তু ঠিকই ‘দেহঘড়ি’ ধরে চলে। তবে ডাক্তার জানালেন দেহঘড়ি একটা নয়, অনেকগুলো। জীবন চক্রকে যদি বড় দেহঘড়ি বলি, তবে শরীরের বাকি সব সিস্টেম তা সে পরিপাকতন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র, রেচনতন্ত্র বা প্রজননতন্ত্র যা-ই হোক না কেন, নিজেরাও যে ঘড়ি ধরে চলে সেগুলো একেকটা ছোট ঘড়ি। ঘুমও চলে তার ঘড়ি বা চক্র ধরে। আর এই ঘুমের চক্র নিয়ন্ত্রণ করতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে আলো—সূর্যের আলো, বিদ্যুৎ বাতির আলো আর অধুনা সেই নীল আলো। এই ঘুমের চক্র হয়তো সবার একরকম হয়। কিন্তু ঘুমের চক্র ঠিক না থাকলে ঘুমের ব্যাঘাত হবে।

ঘুমের সঙ্গে নানা ধরনের হরমোন নিঃসরণের সম্পর্ক নিতান্তই প্রত্যক্ষ। আপনার ঘুম ভালো না হলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমনের ভারসাম্য নষ্ট হবে। আর এর ফলে আপনার শারীরিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে, আপনি ক্ষুধামান্দ্য রোগে ভুগতে পারেন আবার মুটিয়েও যেতে পারেন, শরীরে ডায়াবেটিস বাসা বাঁধতে পারে, যৌন জীবনে সমস্যায় পড়তে পারেন।


রবীন্দ্রানাথ বাঙালি সন্তানের বর্ণনা দিতে গিয়ে যখন বলেন ‘তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু /নিদ্রারসে ভরা’, তখন তিনি নিশ্চয়ই বাঙালির দিবানিদ্রাপ্রিয়তার কথাই বলেতে চান। এই দিবানিদ্রা বা ‘ভাতঘুম’ বাঙালির মৌরসী-পাট্টা মনে করার কারণ নেই। লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের পাঠকেরা ‘সিয়েস্তা’ শব্দটির সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচিত আছেন। স্প্যানিশ ভাষায় ‘সিয়েস্তা’ আর ইতালীয় ভাষায় ‘রিপসো’র অর্থ হলো ‘দিবানিদ্রা’। পৃথিবীর উষ্ণাঞ্চলীয় দেশগুলোর লোকজন দিনে কমবেশি ঘুমায়। পশ্চিমা বিশ্বেও ‘পাওয়ার নেপ’ নামে দিবানিদ্রা জনপ্রিয় হচ্ছে। নাসার গবেষকেরা দাবি করেন, এই ২০ মিনিটের ঘুম বুদ্ধিমত্তা ও স্মরণশক্তি বাড়ায়।

ডাক্তার কবির বলেন, দিবানিদ্রা বা ‘পাওয়ার ন্যাপ’ নিতে হবে ২০ মিনিট। বেশি সময় ঘুমালে শরীরে একটা জড়তা ভাব চলে আসে। কেউ কেউ আবার বলেন, চাইলে পাওয়ার ন্যাপের আগে আপনি এক কাপ কফি পান করতে পারেন। কফির ক্যাফেইন শরীরকে চাঙা করে। কফি পানের ২০ থেকে ৩০ মিনিট পর ক্যাফেইনের কাজ শুরু হয়। সেই ফাঁকে আপনি ঘুমিয়ে উঠে দ্বিগুণ চাঙা হলেন।

নিদ্রা সমস্যার রকমফের সম্পর্কেও জানা গেল সেদিন। কারও ঘুম কম, কারও বেশি, কারও ঘুম আসতে দেরি হয়, কারও ঘুম শেষ রাতে ভেঙে যায়, কারও ঘুম এই আসে এই যায়। যাঁদের দিনে ঘুম পায়, তাঁদের অনেকেই নিদ্রাশ্বাস বৈকল্যের জন্য রাতে ঘুমাতে পারেন না। ঘুম এলেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে ঘুম ভেঙে যায়। আবার নারকোলেপসি নামের এক জেনেটিক রোগের কারণে কেউ কেউ প্রচণ্ড ঘুমকাতর হন। আবার কারও ঘুমকাতরতার কারণ এখনো অজানা।


ডাক্তার কবিরের আলোচনা শেষ হওয়ার পর দেখা গেল সেদিনের আড্ডায় উপস্থিতদের মধ্যেও ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন এমন লোকের অভাব নেই। কেউ একটানা দিনের পর দিন না ঘুমিয়ে থাকার এবং ঘুম এলে টানা তিন দিন ঘুমানোর গল্প শোনালেন। কেউ বললেন কাল ঢাকার বাইরে যাবেন জরুরি কাজে, কিন্তু গত কদিন ঘুম হচ্ছে না। ঘুমের ডাক্তার কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান দিয়ে আজ রাতেই তাঁর ঘুমের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন কি না? কারও আবার আমার মতো নাসিকা গর্জনের সমস্যা, কারও বা অন্যকিছু। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ রাতে ঘুমান সাত ঘণ্টা আর দিনে এক ঘণ্টা। কিন্তু সমস্যা হলো প্রতিবার খাওয়ার পর তাঁর ঘুম পায়। সেই ঘুম তিনি তাড়ান ১০ মিনিটের মেডিটেশন করে। নিদ্রা বিশেষজ্ঞের কাছে নিজের তৈরি এই নিদ্রা-চক্র ও নিদ্রা ব্যবস্থাপনা কৌশলের অনুমোদন পেয়ে সায়ীদ স্যার বেশ আশ্বস্ত হলেন।

ডাক্তার হুমায়ুন কবিরের ঘুমের বই সম্পর্কে কিছু না বলে শেষ করা অন্যায় হবে। কারণ, আমার এই লেখার প্রায় সমুদয় তথ্য আমি নিয়েছি তাঁর ‘ঘুম নিয়ে কিছু কথা’ বই থেকে। তবে এই লেখা বইটির কোনো পর্যালোচনা নয়। কারণ, বইয়ে আরও অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে, যেগুলো সম্পর্কে আমি কিছুই উল্লেখ করিনি। লেখক ঘুম বিষয়ে পণ্ডিত হলেও এই বইয়ে তিনি পাণ্ডিত্য প্রকাশের চেষ্টা করেননি। অতি সরল কিন্তু আকর্ষণীয় ভাষায় জটিল বিষয়গুলো বর্ণনায় তাঁর মুনশিয়ানা অনবদ্য। ‘পরের ধনে পোদ্দারি’ করে লেখা আমার এই কলাম পড়ে ঘুম পেলেও ঘুম নিয়ে লেখা ডাক্তার কবিরের বই পড়তে আপনাদের ঘুম পাবে না, সে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।

চৌধুরী মুফাদ আহমদ। প্রাবন্ধিক
[email protected]