ইসির নিষ্ক্রিয়তা অস্বস্তি বাড়িয়েছে

পরিবেশ বিপর্যয়কারী ল্যামিনেট করা পোস্টার বড় একটি অস্বস্তির উৎস
পরিবেশ বিপর্যয়কারী ল্যামিনেট করা পোস্টার বড় একটি অস্বস্তির উৎস

ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচন আমাদের দ্বারপ্রান্তে। কারসাজিপূর্ণ গত জাতীয় ও পরবর্তী কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর তারিখে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার সময় থেকেই আসন্ন নির্বাচন নিয়ে অনেকের মনে অস্বস্তি ছিল। নির্বাচন-পূর্ব গত এক মাসের অভিজ্ঞতা এ অস্বস্তি তো দূর করতে পারেইনি, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা আরও প্রকট হয়েছে।

নাগরিকদের মনে অস্বস্তির একটি বড় উৎস হলো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দল ও প্রার্থীর পক্ষ থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘন ও এগুলো নিরসনে নির্বাচন কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা। ফুটপাত বা রাস্তা দখল করে নির্বাচনী কার্যালয় স্থাপন, প্রতিপক্ষের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা, প্রচারের সময়ে যান চলাচলে বাধা, লাগাতার উচ্চ আওয়াজের শব্দযন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে শব্দদূষণ ও এসএসসি পরীক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটানো ইত্যাদি নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। দুই সিটি করপোরেশনে ৪৩ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগপ্রাপ্ত হলেও এসব আচরণবিধি লঙ্ঘন রোধে তাঁদের থেকে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ অদ্যাবধি লক্ষ করা যায়নি।

এ ছাড়া এ পর্যন্ত ছোট-বড় বেশ কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যার অন্যতম হলো ২১ জানুয়ারি গাবতলী এলাকায় বিএনপির মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের প্রচারণার সময়ে হামলা এবং পরে ২৬ জানুয়ারি তারিখে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যকার গোপীবাগে সংঘর্ষ। এসব দ্বন্দ্ব-হানাহানির ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা যেন অনেকটা দায়সারা গোছের। কমিশন যদি গাবতলীর ঘটনার পর দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নিত, তাহলে গোপীবাগের ঘটনা এড়ানো যেত।

সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক হলো যে একজন নির্বাচন কমিশনারের মতে, আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে কমিশনের সভায় কোনো আলোচনাও হয় না। অর্থাৎ নির্বাচনী আচরণবিধি রোধে তারা শুধু নিষ্ক্রিয়ই নয়, পুরো নির্বাচন সম্পর্কেই তারা যেন নির্বিকার। অবস্থা দেখে মনে হয় যে নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যেন ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। ক্ষমতাসীনেরা রুষ্ট হয়, এমন কাজ থেকে তাঁরা যেন বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কোনোভাবেই সম্ভবত তাঁরা সরকারের বিরাগভাজন হতে চান না। এ ধরনের মানসিকতার পরিণতি অশুভ হতে বাধ্য। এর ফলে নির্বাচনের দিন সহিংসতা এড়ানো যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।

নির্বাচনের দিনে সহিংসতার একটি বড় উৎস হতে পারে দুটি প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীরা। এ ছাড়া অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে অতীতে যাঁরা কাউন্সিলর হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই বিরাট অর্থবিত্ত ও প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েছেন। তাই প্রার্থীদের অনেকেই কাউন্সিলর হতে মরিয়া। অনেক দিন থেকেই, বিশেষত রকিবউদ্দীন কমিশন থেকে শুরু করে আমাদের নির্বাচন কমিশনের আরেকটি মানসিকতা দৃশ্যমান। তাঁরা কমিশনকে অনেকটা ‘পোস্ট অফিস’ হিসেবে দেখেন, অর্থাৎ স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো অঘটনের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেওয়া তাঁদের দায়িত্ব নয়। তাঁদের মতে, কোনো বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে হলে আগে কমিশনের কাছে অভিযোগ করতে হবে। সিইসি ও অন্য নির্বাচন কমিশনাররা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীন সাংবিধানিক পদ অলংকৃত করে আছেন, সেটা যেন তাঁরা উপলব্ধি করতেই পারছেন না!

অস্বস্তির আরেকটি কারণ হলো কাউন্সিলর প্রার্থীদের সংখ্যায় নিম্নগতি ও মানে অবনতি। আসন্ন নির্বাচনে ৭৩৬ জন প্রার্থী সাধারণ ও সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আগের ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮৪৮, যদিও এবার ওয়ার্ডের সংখ্যা ২০১৫-এর তুলনায় ৯৩ থেকে বেড়ে ১২৯ হয়েছে। প্রার্থী সংখ্যা কম হওয়ার তাৎপর্য হলো, কম প্রার্থী মানে কম যোগ্য প্রার্থী এবং কম যোগ্য প্রার্থী মানে কম যোগ্য নির্বাচিত ব্যক্তি। প্রার্থীর সংখ্যা কম হওয়ার কারণ হলো কাউন্সিলর পদে দলে দলীয় সমর্থন—বস্তুত দলীয় মনোনয়ন—যদিও আইনগতভাবে এগুলো নির্দলীয় নির্বাচন। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যে আইন ও বিধিবিধানের প্রতি সামান্যও তোয়াক্কা করে না, এটি তারই আরেকটি দৃষ্টান্ত।

এ ছাড়া অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের ফলে প্রার্থীর মানের অবনতি ঘটে। এবারও তা ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, এবার প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতায় অবনতি ঘটেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে প্রার্থীদের মধ্যে ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্যদের হার। ব্যবসায়ী ও ধনাঢ্যদের রাজনীতি ও নির্বাচিত পদে আসার ব্যাপারে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু শুধু ব্যবসায়ীরাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হয়ে এলে, সেসব প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখতেই বেশি তৎপর থাকবে, সব নাগরিকের স্বার্থে নয়। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এটা কোনোভাবেই ইতিবাচক নয়।

আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে অস্বস্তির অন্য একটি কারণও রয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকেরা রাষ্ট্রের মালিক। আর এই মালিকেরা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্ধারণ করেন, যে প্রতিনিধিরা মালিকদের স্বার্থে ও কল্যাণে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন। সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য নাগরিকদের অবশ্যই সম্ভাব্য প্রতিনিধিদের সম্পর্কে জানতে হবে। তাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার আজ আইনগতভাবে স্বীকৃত।

আমাদের সিটি করপোরেশন আইনে ও নির্বাচনী ম্যানুয়ালে প্রার্থীদের তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অপরাধের খতিয়ান, আয় ও সম্পদ ইত্যাদির হিসাব হলফনামা আকারে এবং আয়কর বিবরণী তাঁদের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়ার এবং এসব তথ্য ভোটারদের জন্য নির্বাচন কমিশনের উন্মুক্ত করার বিধান রয়েছে। এই উন্মুক্ত করার লক্ষ্য হলো ভোটারদের তথ্য দিয়ে ক্ষমতায়িত করা, যাতে তাঁরা জেনেশুনে-বুঝে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারেন। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন একধরনের তুঘলকি কাণ্ড করেছে। তারা অতীতের মতো সব তথ্য, বিশেষত প্রার্থীদের সব আয়কর বিবরণী তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেনি। ফলে ভোটারদের প্রার্থীদের সম্পর্কে জানার অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। এ অবস্থায় আমরা ‘সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ’ পক্ষ থেকে কমিশনকে উকিল নোটিশ দিতে বাধ্য হয়েছি, যদিও তার কোনো প্রতিকার পাইনি।

এ ছাড়া আমাদের বহুদিনের দাবি সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের প্রদত্ত তথ্য যাচাই করে দেখতে আবারও অনীহা দেখিয়েছে। ফলে অনেক প্রার্থী তাঁদের হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন বা ভুল তথ্য দিয়েছেন। যেমন, দুজন হেভিওয়েট মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে তথ্য গোপন ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদানের অভিযোগ উঠেছে। আর ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নাগরিকেরা বিভ্রান্তই হন, ক্ষমতায়িত হন না।

নির্বাচন সামনে রেখে আরেক কারণেও আমরা অস্বস্তিতে আছি। কয়েক সপ্তাহ ধরে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার অংশ হিসেবে প্রার্থীদের পক্ষে লাখ লাখ পোস্টার টানানো ও লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। এসব লিফলেটের অনেকগুলোই ল্যামিনেট করা, যা পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাতে বাধ্য। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে নির্বাচনের পর সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এসব অপসারণ করা না হলে এর অধিকাংশই নালা ও নর্দমায় যাবে, যা বর্ষাকালে মহানগরে ভয়ানক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করবে। আশার কথা, আমাদের আদালত নির্বাচনের পরে প্রার্থীদের নিজ উদ্যোগে এগুলো অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু কে তা নিশ্চিত করবে? নির্বাচন কমিশন তা করবে, এমন আশা করার ক্ষেত্রে ভরসা পাওয়া দুরূহ।

পরিশেষে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আরেকটি বড় অস্বস্তির উৎস হলো ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে ইভিএমের ব্যবহার। এর মূল কারণ আস্থার সংকট। যন্ত্রটি নিয়ে আস্থার সংকট এবং সর্বোপরি যন্ত্রটি ব্যবহারকারী নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার অভাব। ইভিএম যন্ত্রটি নিয়ে আস্থার সংকটের কারণ হলো, যেকোনো যন্ত্রই শতভাগ নির্ভরযোগ্য নয়, এগুলোকে বিভিন্নভাবে ‘কেলিব্রেট’ বা নির্দেশনা দেওয়া যায়। এ ছাড়া এতে ‘ভোটার-ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি) নেই, যা থাকলে ভোটার জানতে পারতেন, তাঁর প্রদত্ত ভোট কার পক্ষে পড়েছে এবং নির্বাচন-পরবর্তীতে অভিযোগ উঠলে ভোট পুনর্গণনা করা যেত।

অতীতে নির্বাচনী জালিয়াতিতে যুক্ত হওয়ার কারণে নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থার সংকট থাকাই স্বাভাবিক। ভোটার শনাক্ত করার ক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা, যা ভোটারের অনুপস্থিতিতেই তাঁর হয়ে কর্মকর্তার পক্ষে ভোট প্রদান করা সম্ভব এবং ইভিএমে ভিভিপিএটি না থাকা, যা ভোট পুনর্গণনাকে অর্থহীন করে তুলবে। অর্থাৎ কমিশন যে ফলাফল ঘোষণা করবে তা-ই মেনে নিতে হবে, কারণ ভোট পুনর্গণনার মাধ্যমে তা ভেরিফাই করার কোনো সুযোগ থাকবে না।

অবশ্য কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে ইভিএমের ফলাফল আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে। এটা আসলে বিভ্রান্তি সৃষ্টির আরেকটি অপকৌশল। আর আদালতে যাওয়া যে হিমাগারে যাওয়ার সমতুল্য, তা ভুক্তভোগীদের সবারই জানা। আমাদের জানা মতে ১৩ মাস পার হয়ে যাওয়ার পরও গত জাতীয় নির্বাচনের পর দায়ের করা নির্বাচনী বিরোধের একটিরও শুনানি হয়নি, যদিও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী এগুলো ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা।

এত অস্বস্তি ও হতাশার মধ্যেও আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে—এই আশায় আমরা বুক বাঁধতে চাই।

ড. বদিউল আলম মজুমদার: সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক