সময় কেবল সামনে যায়, পেছনে যায় না কেন

চট্টগ্রামে সেদিন ফিজিকস অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় একজন স্কুলশিক্ষার্থী প্রশ্ন করে, ‘সময় কেন কেবল সামনে এগিয়ে যায়, কখনো পেছনে যায় না কেন।’ সেটা ছিল প্রশ্নোত্তরপর্ব। এর আগে এক ঘণ্টার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে এসেছে শিক্ষার্থীরা। হাজারের বেশি শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে। সবার মধ্যে দারুণ উৎসাহ। এখানে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় উৎসবে ওরা যোগ দেবে। তারপর সেরা কয়েকজন শিক্ষার্থী যাবে বিদেশে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য।

এর আগেও জাতীয় অলিম্পিয়াড নির্বাচিত হয়ে আন্তর্জাতিক ফিজিকস প্রতিযোগিতায় আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে সিলভার-ব্রোঞ্জ পদক জয় করে এনেছে। দেশের সুনাম হয়েছে। পরে বিদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের বিশেষ স্কলারশিপ দিয়ে পড়ার সুযোগ দিয়েছে। বাংলাদেশের কিশোর-তরুণেরা এভাবে আন্তর্জাতিক মেধার জগতে নিজেদের বিশেষ স্থান নিশ্চিত করছে।

শিরোনামের প্রশ্নটির কথাই চিন্তা করুন। আমরা তো সব সময় ধরেই নিয়েছি সময় এগিয়ে যায়। ওর পেছনে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এটা নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা যায়, তা আমাদের মাথায় সহজে আসে না। ধরে নিই এ তো স্বতঃসিদ্ধ, কারণের প্রশ্ন ওঠে কেন? অথচ এর ভেতরেও যে বিজ্ঞানের জটিল মারপ্যাঁচ আছে, সে বিষয়ে আমরা কমই গুরুত্ব দিই। কিন্তু দেখুন, স্কুলের একজন শিক্ষার্থী ঠিকই ধরতে পেরেছে যে সময়ের ব্যাপারে এই প্রশ্নের উত্তরটা জানতে চাওয়ার মতো একটা বিষয় হতে পারে। অথচ এত দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের মাথায় কিন্তু এ ধরনের প্রশ্ন সহজে ঢোকে না।

এটাই কিশোর-তরুণদের বৈশিষ্ট্য। ওদের মাথায় কেবল প্রশ্ন নাড়াচাড়া দেয়। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলে গেছেন, কখনো প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকবে না। আমাদের উচিত, প্রকৃতি ও বিশ্বের সব ঘটনার ভেতরের কারণ জানার জন্য কেবল প্রশ্ন করা। এমনকি বোকার মতো প্রশ্ন করতেও দ্বিধা করার কিছু নেই। কারণ, প্রশ্ন সাধারণ শোনালেও উত্তরের মধ্যে হয়তো অনেক দামি কথা লুকানো থাকে। সেটা জানা যায় প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে।

যে কিশোর সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, সে ভবিষ্যতে একজন বড় মাপের বিজ্ঞানী হতে পারে। আমরা হয়তো কয়েক বছরের মধ্যেই সেটা জানতে পারব। বিজ্ঞানী হবে তার প্রশ্ন করার ও জানার আগ্রহের মধ্য দিয়ে।

প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমরা তিনজন মঞ্চে ছিলাম। এঁদের দুজনই ছিলেন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের। তাঁরা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। বোঝানোটা কঠিন। তবে সহজে বলা যায়, এই মহাবিশ্বে বিভিন্ন ঘটনা একের পর এক ঘটে চলেছে। এ অবস্থায় অবস্থানগত পরিস্থিতিকে পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় ‘এনট্রপি’ বলা যায়। সহজ কথায় এনট্রপি হচ্ছে কোনো ঘটনার বিশৃঙ্খলা। থার্মোডিনামিকসের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী কোনো নির্দিষ্ট অবস্থানে সীমাবদ্ধ ব্যবস্থার এনট্রপি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই চলে। মহাবিশ্বে যেকোনো ঘটনার এনট্রপি সব সময় বেড়েই চলে, কখনো কমে না। অর্থাৎ এনট্রপি পেছনে যেতে পারে না। আমরা এই এনট্রপির পরিবর্তন মাপি ‘সময়’ দিয়ে।

সময় ব্যাপারটা এতই জটিল যে কাউকে সহজে বুঝিয়ে বলা কঠিন। যেহেতু এনট্রপি অনবরত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, তাই সময় চলমান। সামনের দিকেই সময় বয়ে চলেছে, পেছনে যাওয়ার উপায় নেই।

অবশ্য এখানে একটি ব্যাপার আছে। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা বা রিলেটিভিটি তত্ত্ব অনুযায়ী, আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে চললে সময় বেশ ধীরে চলে। আপনি যদি দ্রুতগতির রকেটে পাঁচ-দশ বছর মহাশূন্যে ঘুরে আসেন, তাহলে ফিরে এসে দেখবেন আপনার সমবয়সী বন্ধুবান্ধব সবাই যেন কয়েক বছর বুড়িয়ে গেছেন, আর আপনি মোটামুটি তরুণ আছেন। এ অবস্থায় অবশ্য কেউ বলতে পারেন, মহাশূন্য পরিভ্রমণের সময় পৃথিবীর সময়ের তুলনায় রকেটে আপনার ঘড়ির সময় তো বলতে গেলে পেছনেই চলেছে। এটা অবশ্য ভিন্ন একটি পরিস্থিতি। কারণ এটা আপেক্ষিকতার সূত্র অনুযায়ী পর্যবেক্ষক সাপেক্ষে সময় ধীরে চলে, পেছনে যাচ্ছে না। তাই সামগ্রিকভাবে গোটা মহাবিশ্বে সময় সব সময় শুধু সামনেই যায়, পেছনে চলে না।

অনুষ্ঠানের শেষ দিকে রুবিকস কিউব প্রতিযোগিতা হলো। আগেও দেখেছি বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কিন্তু চট্টগ্রামে একটা নতুন জিনিস দেখলাম। একজন তরুণ চোখে পট্টি লাগিয়ে একেবারে না দেখে কয়েক সেকেন্ডেই কিউব মিলিয়ে সবাইকে চমকে দিল। প্রথমে কিউবের ঘরগুলো এলোমেলো করে তার হাতে তুলে দিলে সে মিনিটখানেক পর্যবেক্ষণ করল। মনে মনে একটু হিসাব করে নিল কোনটার পর কোন ঘরের ঘুঁটি কোন দিকে ঘোরাতে হবে। তারপর চোখে রুমাল বেঁধে ওপর দিকে মুখ রেখে কিউব ঘোরাতে শুরু করল। এবং না দেখেই কিউব মিলিয়ে দিল। অসাধারণ মেধার অধিকারী এই তরুণ, নাম তার তোফায়েল আহমেদ। এর আগে আমন্ত্রিত হয়ে বিদেশে গিয়েও তার এই অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে।

আমরা আশা করি, আর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বে একজন অদ্বিতীয় মেধাবী হিসেবে তার নাম আসবে। গিনেস রেকর্ডে তো নাম উঠবেই।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক