সরকারি কর্মকর্তাদের ফোন ধরা না-ধরা

ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা অফিস ও বাসায় টেলিফোন সুবিধা পেয়ে থাকেন। পান মোবাইল ব্যবহারের সুবিধাও। এর প্রয়োজন আছে। সরকারি কাজে তাঁদের বিভিন্ন স্থানে টেলিফোন কিংবা মোবাইলে প্রায়ই যোগাযোগ করতে হয়। ঊর্ধ্বতন অধস্তনের সঙ্গে সমন্বয়, আন্তবিভাগীয় কাজকর্মের যোগাযোগ, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সংযোগের জন্য এ ধরনের টেলিফোন সুবিধা আবশ্যক। ঠিক তেমনি এই কর্মকর্তাদের কাছে যেসব নাগরিকের বিভিন্ন বিষয়াদি বিবেচনাধীন থাকে, তাঁদেরও আবশ্যক হয় ফোন কিংবা খুদে বার্তায় সংযোগ। মোবাইল ফোন প্রসারের ফলে এখন প্রায় সবাই এর আওতায় রয়েছেন। তাই সরকারি অফিস ও কর্মকর্তাদের কাছে অধিকতর টেলিযোগাযোগ অস্বাভাবিক নয়। ধরে নিতে হবে যাঁর প্রয়োজন রয়েছে, তিনিই করেন যোগাযোগ। সাধারণত বিনা কারণে এসব ফোন হয় না। 

আর সরকারি কর্মকর্তারা যখন সরকারি অর্থে এসব ফোন ব্যবহার করেন, তখন সাধারণ জনগণ প্রয়োজনে এসব নম্বরে যোগাযোগ করার অধিকার রাখেন। ব্যবস্থাটি মোটামুটি চলছিল। কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ফোন ধরায় অনীহা সম্পর্কে অভিযোগ ছিল বরাবরই। তবে বাস্তবেই এঁদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। ছিল না এসব বিষয় নিয়ে অভিযোগ তেমন একটা। তবে হালে অবস্থাটার অবনতি ঘটেছে। আর তা বহুলাংশে। এ বিষয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়ে আলোচনায় এসেছেন সদ্য সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব। তিনি এখনো সরকারি দায়িত্বে ওয়াশিংটনে আছেন। তাঁর পোস্টটি একটি বাংলা দৈনিকে খবর হিসেবেও এসেছে। তাঁর মতে, সহকর্মীদের বেশ কয়েকজন এখন তাঁর ফোন ধরছেন না। পড়ে দেখছেন না খুদে বার্তাও।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব উল্লেখ করেছেন, তাঁর বিদেশ থেকে করা কলের ফোন নম্বর সেভ করা না থাকায় এসব ফোন না ধরার প্রধান কারণ হতে পারে। আর কর্মকর্তাদের একটি অংশ ফোন নম্বর সেভ করা না থাকলে তা ধরেন না। সদ্য সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব একজন সজ্জন ব্যক্তি। তাঁকে আমি সময়ে-সময়ে ফোন করতাম। তিনি ব্যতিক্রমহীনভাবেই সেসব ফোন ধরতেন। যতটুকু জানি তিনি প্রায় সব ফোনই ধরতেন। তবে অনেক সময় সভা কিংবা অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে থাকলে ফোন ধরা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া অজানা নম্বর থেকে ফোন এলে সেটা না ধরার একটা সংস্কৃতি ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। এটা বেদনার সঙ্গে আমিও লক্ষ করেছি। কিছু ক্ষেত্রে হয়েছি এর শিকার। 

এটা নিয়ে আলোচনা করতে সূচনাতেই বলতে হয় মাঠপর্যায়ের যেকোনো বিভাগের কর্মকর্তারা অনেকটা জনগণের কাছে অবস্থান হেতু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ সহজতর। গুটিকয় ব্যতিক্রম ব্যতীত তাঁদের সম্পর্কে টেলিফোন না ধরার অভিযোগ তেমন একটা নেই। প্রকৃতপক্ষে এটা সম্ভবও নয়। তবে মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর, সংস্থাগুলোর সঙ্গে অনেক কারণে যোগাযোগ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। সর্বোচ্চ পদে আসীন থেকে সদ্য সাবেক হওয়া একজন কর্মকর্তার উপলব্ধির ব্যাপকতা গুরুত্ব দিয়ে দেখার মতো। 

প্রথমত, টেলিফোন নম্বর জানতে হবে। সচিবালয় টেলিফোন গাইডসহ অন্যান্য সংস্থা এ ধরনের গাইড বের করে। তবে চাকরিতে বদলি, পদোন্নতি, অবসর বা বিভিন্ন কারণে ক্রমাগত রদবদল ঘটতেই থাকে। তাই এ ধরনের গাইড সময়ের দাবির সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না। তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের ফলে এগুলোর স্থান করে নিয়েছে ওয়েবসাইট। অনেক প্রতিষ্ঠানেরই এখন ওয়েবসাইট রয়েছে। তবে লক্ষণীয় যে এর অনেকগুলো করা হয় না হালনাগাদ। তা ছাড়া, কর্মকর্তাদের পরিচিতিতে শুধু দপ্তরের নম্বর দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে কিছু ওয়েবসাইট। বাসভবনের টেলিফোন কিংবা মোবাইল টেলিফোন নম্বর দেওয়া হয়নি অনেক ক্ষেত্রে। অথচ ছুটির দিনে কিংবা অফিস সময়ের পরও অনেকের প্রয়োজন হয় সেসব কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার। আর নম্বরই যদি না থাকল, তাহলে যোগাযোগ করবে কীভাবে? 

অথচ শাসনব্যবস্থাকে অধিকতর গণমুখী করতে সরকার বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। যেমন সিটিজেন চার্টার, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলপত্র, গ্রিভ্যান্স রিড্রেস সিস্টেম (জিআরএস)। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সীমিত কিছু বাদ দিয়ে সরকারের সব তথ্যই নাগরিকদের পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তথ্য অধিকার আইন সেটাকে করেছে নিশ্চিত। বাসভবনের টেলিফোন কিংবা মোবাইল ফোন নম্বর অতি সীমিত গুটিকয় সরকারি পদাধিকারী ব্যতীত অন্যগুলো উন্মুক্ত থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন। বিনা প্রয়োজনে কেউ কারও শান্তি ভঙ্গ করবে, এটা বিরল ক্ষেত্রে হতেও পারে। তবে তার জন্য জনগণের করের টাকায় যে সুবিধা প্রদান করা হয়েছে, তার সুফল থেকে নাগরিকদের বঞ্চিত করা যাবে না। এগুলো উন্মুক্ত করতে হবে সবার জন্য। 

এরপর আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে ফেসবুক পোস্টটিতে। প্রাপকের নম্বর জানা। কল আসছে। এ প্রান্তে কল ধরছেন না, অন্য প্রান্তের ফোন নম্বর অচেনা বলে। এমনকি যখন খুদে বার্তা পাঠিয়ে অনুরোধ করা হয়, তখন কল প্রেরকের পরিচিতি গোপন থাকে না। দীর্ঘদিনের পরিচিত সহকর্মীর প্রতি নিশ্চয়ই টেলিফোন পাওয়া কর্মকর্তা বৈরী নন। তবে তিনি স্বভাবগতভাবে খুদে বার্তা সব সময় দেখেন না। এটাকে অবশ্যই উন্নাসিকতা বলতে হবে। আর সাধারণ মানুষের অবস্থা কী হবে? অথচ তাদেরও তো সময়ে-সময়ে কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা আবশ্যক হয়। অথচ ব্যাপারটি কি অসম্ভব? 

শুধু আমাদের কর্মসংস্কৃতিতে একটু পরিবর্তন আনলেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। আমরা বুঝতে পারি কিছু কর্মকর্তা কাজের চাপে থাকেন। এ অবস্থায় কোনো ধরনের অতিরিক্ত চাপ তাঁরা চান না। আর ফোন ধরাকেও তাঁরা চাপের একটি অংশ মনে করেন। আর নিচ থেকে উঁচু, সব স্তরেই হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও সব না হলেও অনেক টেলিফোন ধরা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনোটি বিরক্তিকর হয় না এমন নয়। তবে ফোনটি ধরতে হবে। আর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা তো সার্বক্ষণিক জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকার কথা। এর মধ্যে ফোন ধরাও একটি সেবা। এতেই কিন্তু অনেক কাজ হয়। এসব কথা সরকারি বিভিন্ন সভায় সময়ে-সময়ে আলোচিত হয়। কিন্তু এ বৈরী সংস্কৃতি নিরসনে আমরা এখন পর্যন্ত ক্রম পশ্চাদমুখী অবস্থানেই আছি। 

এটা করতে হলে প্রতিটি সংস্থার ওয়েবসাইটে কর্মরত প্রাসঙ্গিক সব কর্মকর্তার নাম, দাপ্তরিক, আবাসিক ও মোবাইল নম্বর ও ই-মেইল ঠিকানা থাকতে হবে। প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করার প্রয়োজন রয়েছে এসব ওয়েবসাইট। সংশ্লিষ্ট অফিসপ্রধান এটা তদারক করতে থাকবেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বিষয়টির নজরদারির জন্য ব্যবস্থা নিতে পারে। কোনো কর্মকর্তা ফোন ধরছেন না, এমন অভিযোগে তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে নিতে হবে বিধিসম্মত ব্যবস্থা। আর এমনটা যে করা হচ্ছে, এটাকে জনগণের মধ্যে জানান দিতে হবে। প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমের সহায়তা নেওয়া যায়। এ ধরনের সেবা পাওয়া জনগণের অধিকার। এ বিষয়ে তাঁদের সচেতন করারও প্রয়োজন রয়েছে। 

কর্মসংস্কৃতির পরিবর্তন রাতারাতি হবে না। তবে লেগে থাকলে ধীরে ধীরে হতে থাকবে। একজন কর্মকর্তাকে টেলিফোনের আওতায় পাওয়া বড় ব্যাপার না-ও হতে পারে। আবার এ ধরনের একটি টেলিফোন কল দ্রুত একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তের দ্বার খুলে দিতে পারে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানতে পারেন তাঁর কোনো অধস্তনের অন্যায্য আচরণ সম্পর্কে। একজন সদ্য সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব তাঁর সাবেক সহকর্মীদের সঙ্গে প্রয়োজনমতো যোগাযোগ করতে পারছেন না। আবার অনেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়াও দিচ্ছেন। এ কর্মকর্তার আলোচ্য ফেসবুক পোস্ট দেখলে মনে হবে তাঁর কাছে গোটা দেশটি অনেক বদলে গেছে। তিনি এখনো সরকারি দায়িত্বে। আর যিনি বা যাঁরা কিছুতেই নেই বা ছিলেন না, তাঁদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। কর্মকর্তাদের ফোন ও ই-মেইল নম্বরের অসম্পূর্ণতা নিয়েই বা হালনাগাদ না করে ওয়েবসাইট রাখার কোনো মানে নেই। আমরা সবাই একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠলে তেমন কোনো বড় দায়িত্ব মাথার ওপর পড়বে না। বরং উপকৃত হবেন অনেকে। 

আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব