বহিরাগত 'গুন্ডা' ও 'সশস্ত্র ক্যাডার' তত্ত্বে হঠাৎ উত্তেজনা

সকাল দেখেই দিনটি কেমন যাবে সব সময় বোঝা না গেলেও প্রচারের ধরন দেখে, প্রার্থী ও নেতাদের বচন শুনে অনুমান করা কঠিন নয় যে শনিবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন কেমন হতে পারে। নির্বাচনের দুদিন আগে হঠাৎ করেই পুলিশ জানাচ্ছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ঢাকায় জড়ো হচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকার বহিরাগত ধরতে অভিযানও শুরু করে দিয়েছে।

প্রতিবার যেমনটি হয়ে থাকে, এ ধরনের অভিযানে প্রথম শিকার হন বস্তিবাসী, মেসের বাসিন্দা, ভাসমান মানুষ ও বিভিন্ন প্রয়োজনে ঢাকায় আসা সাধারণ মানুষ। তাঁদের কেউ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে আসতে পারেন, কেউ অসুস্থ স্বজনকে দেখতে হাসপাতালেও আসতে পারেন। তাঁরা কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দেখাবেন? কে ঠিক করবে যে কার ঢাকায় অবস্থানের ‘যৌক্তিক’ কারণ আছে বা নেই।

নির্বাচন এত দিন ছিল উৎসব। এখন পরিণত হয়েছে আতঙ্কে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা একবারও ভেবে দেখেন না যে নির্বাচনে তাঁদের ভাষায় যাঁরা ‘সন্ত্রাস’ করবেন, তাঁরা এভাবে কেউ ঢাকায় আসেন না। তাঁরা আসেন মাইক্রোবাসে করে। তাঁরা আসেন প্রাইভেট গাড়িতে চড়ে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচারের চেয়ে এখন পাল্টাপাল্টি অভিযোগই বড় হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ইতিমধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে গুন্ডা ও সশস্ত্র ক্যাডার জড়ো করার অভিযোগ করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পরিবেশ বিঘ্নিত করতে বিএনপি ঢাকায় গুন্ডাদের জড়ো করছে। তারা সশস্ত্র মহড়া দেওয়ার পরিকল্পনা করছে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩০ জানুয়ারি ২০২০)। অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খোন্দকার মোশারফ হোসেন বলেছেন, দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সহিংসতা চালাতে আওয়ামী লীগ বাইরে থেকে ৩০ লাখ নেতা-কর্মী ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীকে ঢাকায় জড়ো করছে।

এর পাশাপাশি নির্বাচনসংক্রান্ত আরেকটি খবর প্রকাশিত হয়েছে ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার-এ। প্রকাশিত হয়েছে ‘অকুপাই কন্ট্রোল’ পোলিং সেন্টারস শিরোনামে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আয়োজিত এক সভায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের নির্বাচনের দিন সকালে কেন্দ্র দখল ও নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য বলেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘তোমরা খুব সকালে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে তোমাদের ভোট দেবে এবং কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নেবে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ইতিমধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে যে ব্যারিস্টার তাপস ৫৭ শতাংশ ভোটে জয়ী হবেন। তাপসের এই বিজয়ের কথা জানতে পেরে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থী নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। তাঁদের হটিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’

এই তিন নেতার বক্তব্য যদি সত্য হয় তাহলে ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় কী করে! নির্বাচন কমিশনের তো তাহলে নির্বাচন স্থগিত করার কথা চিন্তাভাবনা করা উচিত। কেননা কোনো দল যদি ঢাকার বাইরে থাকে গুন্ডা ভাড়া করে এনে ঢাকা শহরে ভরে ফেলে কিংবা কোনো দল যদি ৩০ লাখ সশস্ত্র ক্যাডার ঢাকায় নিয়ে আসে, তাহলে ঢাকায় তো ভূমিকম্প হওয়ার কথা।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভোটার সংখ্যা ৫৪ লাখ। বিএনপি নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগ ৩০ লাখ নেতা-কর্মী ও সশস্ত্র ক্যাডার ঢাকায় জড়ে করছে! আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংখ্যা না জানালেও গুরুত্ব দিয়েই বিএনপির ষড়যন্ত্র ও তৎপরতার কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন একবার নিজের মন্ত্রণালয়ে বসে, আরেকবার আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে। অন্যদিকে ঢাকার পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলামও বলেছেন, পুলিশের কাছে খবর ছিল নির্বাচনকে সামনে রেখে সন্ত্রাসীরা ঢাকায় জড়ো হচ্ছে। পুলিশ কমিশনার বলেননি, কারা জড়ো করছেন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তারা বিএনপি। খন্দকার মোশাররফ বলেছেন, তারা আওয়ামী লীগ।

এই যে নির্বাচনে সশস্ত্র ক্যাডার বা গুন্ডা ভাড়া করার পারস্পরিক অভিযোগ আসছে, একজন নেতা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সকাল সকাল ভোট দিয়ে কেন্দ্রে নিয়ন্ত্রণ ও ষড়যন্ত্রকারীদের হটিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে তারা মাঝেমধ্যে ক্ষীণ কণ্ঠে দু-একটা কথা বললেও আচরণবিধি মানাতে কাউকে বাধ্য করতে পারেননি। এমনকি করার ইচ্ছাও পোষণ করেননি। নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনসংক্রান্ত সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে কোনো কিছুতে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হয় না। তারা ভোটারদের নিরাপত্তা বা ভোটের পরিবেশ নিয়ে ভাবেন না। ভাবারই কোনো কারণও নেই। একসময় প্রার্থীরা নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানাতেন। এখন নির্বাচন কমিশনেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকার অভিযোগ উঠেছে। একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, তাঁকে বৈঠকে কথা বলতে দেওয়া হয় না। তাঁর কথা আমলে নেওয়া হয় না। এই নির্বাচন কমিশন কী করে প্রার্থীদের লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করবেন।

বৃহস্পতিবার প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম হচ্ছে, বহিরাগত ধরতে অভিযান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই অভিযানে কি সত্যিই সশন্ত্র ক্যাডার বা গুন্ডারা ধরা পড়বেন? এটা কি নিশ্চিত করা যাবে যে এসব অভিযানের নামে কোনো নিরীহ মানুষ নাজেহালের শিকার হবেন না। অথবা সশস্ত্র ক্যাডার শুধু দলবিশেষের মধ্যে খোঁজা হবে না?

আওয়ামী লীগ নেতারা একদিকে বলেন, বিএনপি তিন মিনিটও রাস্তায় থাকার ক্ষমতা রাখে না। আরেক দিকে বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। কোনটি মানুষ বিশ্বাস করবে?

নির্বাচনের দুদিন আগে জনমনে আতঙ্ক ছড়ানোর কারণ কী? এটি কি নিছক প্রতিপক্ষকে কথার বাণে ঘায়েল করা না এমন পরিবেশ তৈরি করা, যাতে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয় এবং তাঁরা ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। ভোটাররা দল বেঁধে ভোটকেন্দ্রে গেলে অনেক অনিয়ম করা করা কঠিন হয়ে পড়ে। ভোটাররা না গেলে যা সহজেই করা সম্ভব।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]