ছেঁড়া ৫০ টাকা, মানুষ আর কুকুরের ছানা

কনকনে শীতের রাতে আমি আর আমার মেয়েটা গিয়েছিলাম ধানমন্ডি ২ নম্বর সড়কের কোনায় ইয়াম চা ডিস্ট্রিক্ট নামের দোকানে ভালোমন্দ খেতে।

আমার পছন্দ ওদের সয়া-গ্লেজ্ড-টোফু-ইন-নানবান-সস এবং কালো মাশরুম আর সবুজ শাকের সালাদ। মেয়ে খায় চিকেন ফ্রায়েড রাইস। আর ওদের নানা তরিকার ছোট ছোট ডিমসাম বা মোমো আমরা দুজনই চাখতে ভালোবাসি।

বছর ঘুরে গেছে সড়কের ধারে সুরম্য উঁচু ভবনটা উঠেছে। কেমন বিদেশ বিদেশ দেখতে। প্রতি তলায় শৌখিন রেস্তোরাঁ আর কাফে। ডমিনোজ দোকানটায় এখনো শুক্র-শনিবারে খাদ্যান্বেষীদের ঢল নামে। মাঝেমধ্যেই রাস্তায় গাড়ির জট বেঁধে যায়।

তো সেই রাতে আমি আর মেয়ে আরও দুটো খাবার নিয়েছিলাম। সব খেয়ে শেষ করতে পারিনি। ঝড়তিপড়তি খাবারের ব্যাগ হাতে ভবন থেকে বেরোলাম। উঁচু ভিত থেকে দেখি, ঢালের গোড়ায় তিনটি শিশু সাদা চিনামাটির বাসনের ভাঙা চাড়ি নিয়ে একমনে কী যেন করছে।

ততটাও আবার একমনে নয়। কেননা আমরা নামতেই তাদের মধ্যে বড় মেয়েটি নিমেষে সামনে হাজির। নরম গলায় সে অনুরোধ করে, ‘খাওয়াটা দিয়া যান না!’ বাকি দুজনও আমাদের ঘিরে ধরে।

টিঙটিঙে রোগা, দুই-আড়াই ফুট উচ্চতার তিনটি বাচ্চা। দুটি মেয়ে, একটি ছেলে। তাদের গায়ে ছেঁড়াখোড়া ফ্রক আর শার্ট, ফুটোফাটা সোয়েটারের হালকাপাতলা আভাস। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল।

ব্যাগটা দিয়ে দিই। দাঁত বের করা হাসি উপহার দিয়ে একছুটে তারা তাদের কাজে ফিরে যায়। আমরা বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েও আবার ঘুরে আসি।

ছেলেটা বড়সড় একটা চাড়ি ইট দিয়ে ঠুকে ভেঙে সমান করছে। মেয়েরা চাড়ির টুকরা গুঁড়া করছে। আমাদের দেখে ছোট মেয়েটি বলে, ‘খাওয়া আমাগো হগলরে দিসেন না? হে কয়, শুধু হেরে দিসেন!’

খাদ্যের ব্যাগ বড় মেয়েটির কোলের কাছে রাখা। আমাদের দেখে সে ব্যাগটা একটু গা ছাড়া করে। ছোট মেয়েটি একমুখ হেসে বলে, ‘যান। দিব, দিব। আমাগোরে দিব।’

কিন্তু তারা করছেটা কী? বড়জন দেখায়, রাস্তায় শুয়ে আছে একটা ৫০ টাকার নোট, পাশে চাড়ির টুকরায় সাদা একটু মণ্ড। বলে, ‘একজনে একটা ছিঁড়া ৫০ টাকা দিসে। পানের দোকান থিকা চুন আনছি। চা-আলার থিকা একটু চিনি।’

চুন-চিনি আর চিনামাটির গুঁড়া মিশিয়ে আঠা তৈরি হচ্ছে। ছেলেটা চাড়ি ভেঙে পাত বানাচ্ছে। সেই অপারেশন টেবিলে নোটের ছেঁড়া গা জোড়া দেওয়া হবে। জানাবোঝা শেষে আমি আর মেয়ে বাসায় ফিরি।

পরদিন শুক্রবার সকালে আমরা লেকপাড়ে হাঁটতে বেরোই। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি সুধাসদনের দিকে রাস্তাটা যেখানে মোড় নিয়েছে, সেখানে কয়েক দিন আগে আটটা যমজ ছোট্ট কুকুরছানা দেখেছিলাম। সেদিন দেখি, তারা এক ফুট মাপের হয়ে উঠেছে। ভারি মিষ্টি আর দুষ্টু।

দীনহীন নেড়ি মা ছানাদের গায়ের ঘা চেটে সাফ করছে। পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ইটের বেদিটায় মা-মেয়ে বসি। সাদাপোশাকের এক ব্যক্তি বলেন, ইতিমধ্যে একটা ছানা মরে গেছে।মৃতের ভাইবোনেরা এসে আমাদের জামার কোনা ধরে টানে। আশপাশে বিস্কুটের খুচরা দোকানগুলো কিছুদিন আগের অভিযানে উচ্ছেদ হয়েছে। কাছের দ্বীপে একটা নাশতার রেস্তোরাঁ আছে। কিন্তু সেখানে স্বাস্থ্যান্বেষী পদচারীদের লম্বা লাইন।

অগত্যা একটু চা নিয়ে আসি। কুকুরছানারা হুড়মুড়িয়ে জিব পুড়িয়ে মাটিতে ফেলে মিষ্টি চা চাটে। ইতিমধ্যে লেকপাড়ের ঢালে একটা বিস্কুটের দোকান খুললে কিঞ্চিৎ রুটি-কেক কিনে আনি। ছানাগুলো ঝাঁপি ঝাঁপি লাগিয়ে দেয়। একটা তো মেয়ের কোলেই উঠে পড়ে। নেড়ি মা দাঁড়িয়ে ছানাদের খাওয়াদাওয়া দেখে।

চা-নাশতার শেষে। ছবি: সুমিতি অপারাজিতা
চা-নাশতার শেষে। ছবি: সুমিতি অপারাজিতা

একটু তফাতে এক বুড়ি ভিক্ষুক বসেছিলেন। তাঁর জন্য আলাদা করে কেক এনেছিলাম। কিন্তু আমরা সদাই সারতে সারতে তিনি বিদায় নিয়েছেন। তবে ততক্ষণে আরেকজন বৃদ্ধ ভিক্ষুক এসে গেছেন।

অনেকদিন পর সেদিন চমৎকার রোদ উঠেছে। কেক-রুটির টুকরা খেয়ে কুকুরছানারা কেউ রোদে ছোট্ট গা বিছিয়ে বসে। কেউ অন্যদিকে ছুট লাগায় খেলার খোঁজে। আমার গত রাতের মানুষের ছানাদের কথা মনে পড়ে।

আহ্ কী আরাম! ছবি: সুমিতি অপারাজিতা
আহ্ কী আরাম! ছবি: সুমিতি অপারাজিতা

কুররাতুল-আইন-তাহমিনা: সাংবাদিক
[email protected]