বৃহৎ ইসরায়েলের পরিকল্পনায় ট্রাম্প

ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য শান্তির নকশা ইসরায়েলের পক্ষেই গেছে বলে অভিযোগ ফিলিস্তিনিদের। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: এএফপি
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য শান্তির নকশা ইসরায়েলের পক্ষেই গেছে বলে অভিযোগ ফিলিস্তিনিদের। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: এএফপি

শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল মিলে শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করল। মার্কিন-ইসরায়েল লবি একে শতাব্দীর চুক্তি বলে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করছে। সবাই যেন হাঁপ ছেড়ে বলছে, যাক শেষ পর্যন্ত শান্তির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। অনেকটা ‘যার বিয়া তার খবর নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই’ অবস্থা। আরব দেশগুলো সব লাইন ধরে এই শান্তিচুক্তি সমর্থন করছে। সৌদি আরব, ওমান, বাহরাইন, জর্ডান, আমিরাতের মতো দেশগুলো ছিল সমর্থনের প্রথম সারিতে। ওদিকে যাদের জন্য চুক্তি, সেই ফিলিস্তিন কোনোভাবেই একপেশে এই চুক্তি মানতে রাজি না। ইরাক, ইরান, তুরস্কও এর বিরোধিতা করেছে। মিসর সমর্থন দিয়েছে। একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে সমর্থন দেওয়া যাকে বলে, জেনারেল ফাত্তাহ সিসির সরকার তা-ই করেছে। ইসরায়েলের শত্রু মুসলিম ব্রাদারহুডকে সরিয়ে জেনারেল সিসিদের ক্ষমতায় বসানোর প্রতিদান এভাবেই দেওয়া হচ্ছে।

হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিরাষ্ট্রীয় শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখিয়েছেন ট্রাম্প। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী রেখেই এই শান্তি পরিকল্পনা করা হয়েছে। পাশাপাশি জর্ডান উপত্যকা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। শান্তির কথা বলে যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেওয়া হচ্ছে, তা ইসরায়েলে জন্য নতুন ভোর আনবে, এটা সত্য। কিন্তু আরবের জন্য নিয়ে আসবে এক গভীর অন্ধকার।

ফিলিস্তিনের সার্বভৌমত্বকে ইসরায়েল স্বীকারই করে না। তাহলে হঠাৎ করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল এত উঠেপড়ে লেগেছে কেন? কারণ, এ চুক্তি বিশাল এক শুভংকরের ফাঁকি ফিলিস্তিনিদের জন্য। শান্তিচুক্তি সামনে রেখে ভিন্ন এক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ইসরায়েল। এই চুক্তি কার্যকর হলে বাস্তবে ইসরায়েলের মানচিত্র আরও বৃদ্ধি পাবে। কীভাবে? দুই ধাপে। প্রথমে জর্ডান উপত্যকা দখলে নিয়ে ও পরে জর্ডানের এই উপত্যকাকে ইসরায়েলের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে। এসব বিষয়ে ট্রাম্প বা নেতানিয়াহু খোলাসা করে না বললেও অনেক দিন ধরেই ইসরায়েলের পত্রিকাগুলো প্রকাশ করছে এই পরিকল্পনা। ‘জেরুজালেম পোস্ট’ ও ‘হারেৎস’ এ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। শতাব্দীর শান্তিচুক্তিতে পশ্চিম তীরের জর্ডান উপত্যকা দখলে নেওয়ার কথা বলা আছে। কিন্তু এরপর কী হবে? ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল গলাগলি ধরে সুখেশান্তিতে বসবাস করতে থাকবে? নতুন পরিকল্পনা এই দাবি করলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।

‘হারেৎস’ পত্রিকা ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদনে বলেছে, ইসরায়েলে ডানপন্থীদের পরিকল্পনা হচ্ছে জর্ডান উপত্যকা দখল করে নেওয়া। এরপর প্রচারণা শুরু করবে, ঐতিহাসিকভাবেই জর্ডান ইসরায়েলের অংশ। জর্ডানের ক্ষমতা থেকে বাদশাহ আবদুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে। পশ্চিম তীরের সঙ্গে যুক্ত করে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও জর্ডানের মধ্যে একটি কনফেডারেশন করা হবে। ইসরায়েলের নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, এটা যখন বাস্তবায়িত হবে তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনের নাগরিকদের জর্ডানের ওপর অধিকার সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া ইতিমধ্যেই লাখ লাখ ফিলিস্তিনি জর্ডানে অবস্থান করছে। এদের অনেকেরই জর্ডানের পাসপোর্ট রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, জর্ডান উপত্যকা ইসরায়েল দখলে নিলে পশ্চিম তীরের সঙ্গে জর্ডানের কনফেডারেশন কীভাবে হবে? পশ্চিম তীরের সঙ্গে গাজার সংযোগ থাকবে ইসরায়েলের ভেতর দিয়ে। আরব-ফিলিস্তিন কনফেডারেশনের যোগাযোগ থাকবে ইসরায়েলের দখলকৃত পশ্চিম তীরের ভেতর দিয়েই।

জর্ডানকে পশ্চিম তীরের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে পারলে এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করবে ইসরায়েল। প্রথমত, পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা জর্ডানকে সঙ্গে নিয়ে একটি রাষ্ট্র বা কনফেডারেশন করলে ইসরায়েলের সঙ্গে বিবাদ থেকে সরে আসবে। আর ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র করে দিলেও ওই রাষ্ট্র কার্যত ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ ও দখলেই থাকবে। ইসরায়েলিরা ভালো করেই জানে, দুই রাষ্ট্রের তত্ত্ব কার্যত শান্তি আনবে না। বরং ইসরায়েল সময়-সুযোগমতো আরব-ফিলিস্তিন কনফেডারেশনকে দখলে নিয়ে নিজস্ব সীমা আরও বাড়াতে পারবে।

এ জন্যই প্রথমে দ্বিরাষ্ট্রীয় তত্ত্ব দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ রাষ্ট্রই এই তত্ত্বকে সমর্থন করবে। বাস্তবে তা-ই হচ্ছে। অধিকাংশ আরব দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমারা ইতিমধ্যে সমর্থন দিয়েছে। তাই ফিলিস্তিন, তুরস্ক বা ইরান বিরোধিতা করলেও বৈশ্বিক সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল এককভাবেই জর্ডান উপত্যকা দখলে নিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেডিভ ফ্রিডম্যান জর্ডান উপত্যকা দখলের সমর্থন দিয়ে রেখেছেন। জেরুজালেম ও জর্ডান উপত্যকা ছাড়া ফিলিস্তিনিরা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা না করলেও সবাই তাদের স্বীকৃতি দেবে। এরপর আরব-ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা হবে জর্ডান নদীর পূর্বপারে। জর্ডান নদী ইসরায়েল ও আরব-ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ব্যবহার করবে সমানভাবে। ইসরায়েল এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিষয়ে এতটাই আত্মবিশ্বাসী যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারনের পুত্র জিলাদ শ্যারন মনে করেন, এই পরিকল্পনা নাকচ করে দেওয়ার সক্ষমতা জর্ডানের নেই। ইসরায়েল জর্ডানের বাদশাহর দুর্বলতাগুলো ভালো করেই জানে। এবং এ-ও মনে করে যে, বাদশাহ আবদুল্লাহর ক্ষমতায় টিকে থাকা অনেকটাই ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল। আর কোনো কারণে বাদশাহ আব্দুল্লাহ যদি শান্তিচুক্তি বাতিল করেন তবে তেল আবিব সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে অপসারণ করবে। এ ক্ষেত্রে ইসরায়েলকে আরব দেশগুলো তো বাধা দেবেই না, বরং সমর্থন দেবে শান্তির কথা বলে। জর্ডানের বাদশাহ জনরোষ ও ইসরায়েলের কূটকৌশলের মধ্যে আটকা পড়েছেন। জনসাধারণের আয় হ্রাস পাচ্ছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে সহায়তাও কমেছে। বিভিন্ন কারণে জর্ডান ভালো নেই। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে চাইছে ইসরায়েল।

এসব হচ্ছে ইসরায়েলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। জর্ডান দখলের পরিকল্পনা হিসেবেই শান্তিচুক্তি আলোচনার টেবিলে তুলে দিয়েছে মার্কিন-ইসরায়েল লবি। এই পরিকল্পনা অলীক ও অবাস্তব মনে হতে পারে। অনেকেই হেসে উড়িয়ে দিতে চাইবেন। মনে রাখতে হবে, ১৯৪৭-এর আগেও ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠন অলীক ও অবাস্তবই মনে হয়েছিল। বিশেষ করে ১৮৮০-১৮৯৭-এর দিকে যখন জায়নবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং ইহুদিদের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্রের দাবি জানানো হয়। কিন্তু ২০২০ সালে এসে ইসরায়েল রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের থেকে আকারে বড় ও অনেক অনেক শক্তিশালী। নতুন এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিনের বাইরেও ইসরায়েলকে দখলদারি প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেবে ও আরও পোক্ত করবে। ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি পুনরুদ্ধারের দিকে ক্রমেই ইসরায়েল এগিয়ে যাবে আরবদের অনৈক্য, স্বৈরশাসন, গণতন্ত্রহীনতা ও ক্ষমতার লোভের কারণে।

ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক