অর্থনৈতিক কারবারে আস্থার সংকট

দৈনন্দিন জীবনে যাঁদের নিয়ে প্রতিনিয়ত আমাদের চলতে হয়, তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক যা-ই থাকুক, সেখানে পারস্পরিক আস্থার উপস্থিতি আবশ্যক। পরিবারের সদস্যদের মাঝে, আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে, কর্মক্ষেত্রে, সমাজে বা রাষ্ট্রে পারস্পরিক আস্থার কাঠামোটি সর্বস্তরে বিরাজমান। এই আস্থার ব্যাপারটি প্রায়ই অনানুষ্ঠানিক হয়। যেমন মুদি দোকানদার তাঁর পাড়ার বাসিন্দাদের কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়া মাস-বাকিতে পণ্য সরবরাহ করেন। আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চুক্তি বা শপথের ব্যাপার থাকে। যেমন কেউ ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে গেলে তাঁকে ব্যাংকের সঙ্গে যথাসময়ে সুদসহ যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করার ব্যাপারে চুক্তি করতে হয়। নিয়োগকর্তা নিয়োগকৃতকে চুক্তিবদ্ধ নিয়োগপত্র দেন, জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণের শপথ নেন, দুজন মানুষ উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সামনে শপথ করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। যেখানে চুক্তি বা শপথের ব্যাপার থাকে, সেখানে কোনো পক্ষ তা ভঙ্গ করলে অপরপক্ষ আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। আইন ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে বৈষয়িক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে কেবল, কিন্তু এই ঘটনায় পারস্পরিক আস্থার যে অবসায়ন ঘটে, সেটি সাধারণত পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় না। কারণ, আইন করে আস্থা লাভ করা যায় না, আস্থা সৃষ্টি করা যায় না।

ছোট আকারের বা ব্যক্তিপর্যায়ের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চুক্তিবিহীন হতে পারলেও বৃহৎ বা প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের জন্য চুক্তি ছাড়া গতি নেই। অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পারস্পরিক আস্থাটিই প্রধান। আস্থা হারাতে থাকলে সেটি গতি হারাতে থাকে, সমাজে অবিশ্বাস দানা বাঁধতে থাকে। ফলে জাতীয় অর্থনীতিও হুমকির মুখে পড়ে যায়। সাম্প্রতিককালে অপেক্ষাকৃত কম উন্নত দেশগুলোতে অনানুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আস্থাহীনতার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর শুরুটা হয়েছে আনুষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিপুল পরিসরে বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনাবলি থেকে।

এ ধরনের দেশগুলোতে প্রায়ই শেয়ারবাজারে ধস নামে। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অযোগ্যতার দরুন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হন, তাতে শেয়ারবাজারের মতো সুগঠিত ও নিয়মতান্ত্রিক একটি আর্থিক ব্যবস্থা চরম সংকটে নিপতিত হয়। দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ, তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের ক্ষতি লাঘবের উদ্যোগ না নিলে কেবল শেয়ারবাজারের সূচকের অধোগতি হয় না, সঙ্গে সঙ্গে শেয়ারের অবমূল্যায়নের ফলে বাজার থেকে বিপুল অর্থ চলে যায়।

আরও বড় আস্থাহীনতার ঘটনা ঘটে যখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে একই কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে ঋণগ্রহীতারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যত দেউলিয়ায় পরিণত হয়। গ্রাহকদের সঞ্চয় নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ডুবে যাওয়ায় আমানত প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের মাঝে আর ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে আস্থাহীনতা ও ভীতি সৃষ্টি করে। ফলে ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলোর জন্য ঋণ পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে, ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ে।

সুসংবদ্ধ জাতীয় প্রতিষ্ঠানে আস্থাহীনতার প্রভাব ব্যক্তিপর্যায়েও পড়ে। ফলে রাষ্ট্রের যথেষ্ট আশ্বাস ও প্রয়োজনীয় জোগান থাকা সত্ত্বেও এক দিনের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। ঠিক যেমনটা হয়েছিল সম্প্রতি পেঁয়াজের পরে লবণের দামের বেলায়। আগে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশেষত কৃষিকাজ বা মৌসুমভিত্তিক ব্যবসায়ের জন্য ঋণ লাভের বা বাকিতে পণ্য কেনার সহজ ব্যবস্থা ছিল। বৃহৎ ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে অরাজক পরিস্থিতি এবং নানা কায়দায় সাধারণের সঞ্চয় নিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা গ্রামীণ অর্থনীতির আস্থার জায়গাটি নষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে হয় ঋণ লাভের বা বাকিতে পণ্য পাওয়ার সময়কাল কমে যাচ্ছে অথবা তার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যাঁরা কোনো কারণে এক মৌসুমে কৃষিতে বা ব্যবসায় মার খেয়ে ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না, পরের মৌসুমে তাঁদের কেউ ঋণ দিতে বা বাকিতে পণ্য দিতে ভরসা করছেন না।

আস্থার সংকট নিরসন না হলে ব্যক্তিপর্যায়ে বা ক্ষুদ্র উদ্যোগের ক্ষেত্রে পুঁজির জোগান কমে পুঁজির ব্যয় বৃদ্ধি করে। ফলে পণ্য ও সেবার মূল্য এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আস্থার সংকট ঠেকাতে নতুন আইনকানুন প্রণয়ন বা বিদ্যমান আইনকে আরও কঠোর করা হয়। এতে সংকট গভীরতর হয়, কিন্তু এর নিরসন ঘটে না। কৃষি বা ব্যবসায়ের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হলে সাধারণ মানুষ পঞ্জি স্কিম, পিরামিড স্কিম, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ইত্যাদি ফাটকা খাতে অথবা না বুঝে শেয়ারবাজারে সর্বস্ব বিনিয়োগে ধাবিত হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উন্নত দেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাও এই কারণে বৃদ্ধি পায়।

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির অভূতপূর্ব ও দ্রুত উন্নয়নের ফলে মানুষকে সত্য থেকে যেমন দূরে বা বিচ্ছিন্ন করে রাখা যায় না। এতে মানুষকে অদৃশ্য নজরদারিতে আনা সম্ভব হয়েছে। ফলে রাইড শেয়ারিং, লজ শেয়ারিং, অনলাইন মার্কেটপ্লেস, হোম ডেলিভারি, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ইত্যাদির মতো পারস্পরিক আস্থাভিত্তিক সেবা খাত সৃষ্টি ও বৃদ্ধি পেতে পেরেছে। ক্ষুদ্র উদ্যোগে উৎপাদিত পণ্য মধ্যস্বত্বভোগীদের কয়েক ধাপ এড়িয়ে সুবিধাজনক মূল্যে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিতকরণ সম্ভব হলে এই ধরনের সমান্তরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলো মূলধারার অনেক ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপিত করতে সমর্থ হয়ে যাবে। অনেক দেশে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো প্রায়ই নতুন প্রযুক্তিকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের শক্ত হাত প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রভাবকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় সৃষ্ট আস্থার সংকটের ব্যাপারটি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দিয়ে কিছুটা সামাল দেওয়া সম্ভব বটে, তবে তা টেকসই করতে সব পর্যায়ে গণতন্ত্র, সুশাসন, বৈষম্যহীনতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি আর বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। এই কথাগুলো বলা যত সহজ, কাজে পরিণত করা ততই দুরূহ। যুগের পর যুগ আন্দোলন-সংগ্রাম করেও অনেক দেশে এগুলো প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। অথবা একবার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হলেও তা বেশি দিন ধরে রাখা যায়নি। তাহলে সাধারণ মানুষের কি কিছুই করার নেই? অবশ্যই না। সচেতনতা ও অব্যাহত সংগ্রাম রাখাটা যেমন জরুরি, তেমন বিকল্প উপায়ের কথা ভাবাটাও জরুরি।


জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আরিফ: লেখক, প্রকৌশলী
[email protected]