করোনাভাইরাস:তারা ফিরবে! কবে ফিরবে? নাকি ফিরবে না

মার্কিনদের অনুমতি মিলেছে। ২৯ জানুয়ারি ২০১ জন মার্কিন নাগরিক চীনের উহান থেকে উড়াল দিয়ে আলাস্কা হয়ে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় পৌঁছেছে। উড়াল দেওয়ার আগে চীনে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। উড়োজাহাজে তেল ভরার বিরতিতে আলাস্কায় আবার তাদের আগাপাছতলা পরীক্ষা করে দেখা হয়। দুই পরীক্ষাতেই সবাই উতরে গেলেও তাদের আরও সপ্তাহ দুয়েক নজরে রাখা হবে। সিএনএন জানাচ্ছে, তাদের কম পক্ষে ১৪ দিন বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে তৈরি করা বিশেষ ব্যবস্থায় থাকতে হবে।

এর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ঘোষণা করেছিল, ‘ভাইরাসটির সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ বাড়লেও প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্রস্থল (এপিসেন্টার) থেকে বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন নেই।’ এ ধরনের রোগ বিস্তারের প্রতিরোধের জন্য এটাই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আচার বা প্রটোকল। চীন বলেছিল, আর দুই সপ্তাহ দেখি, তারপর বিমান ওঠানামা, লোক পাঠানো, লোক নামানোর কথা ভাবা যাবে। বাংলাদেশের মতো কম বা নেই–ক্ষমতার দেশগুলোকে এসব বলে ঠান্ডা করা গেলেও ঝাড়ি মারার ক্ষমতা আছে—এমন সব দেশকে তাদের ছাড় দিতে হচ্ছে। চাপে পড়ে চীন বলতে বাধ্য হয়েছে, কোনো রাষ্ট্র বেশি পীড়াপীড়ি করলে আমরা পাঠানোর ব্যবস্থা নেব। বাধ্যতামূলক দুই সপ্তাহ বিচ্ছিন্ন রাখার নিয়ম তাদের দেশে গিয়ে পালিত হলেও চলবে। যুক্তরাষ্ট্রের আগে প্রায় ২০০ জন জাপানি নাগরিক উহান থেকে বিমানে করে টোকিওর হানেডা বিমানবন্দরে গিয়ে পৌঁছায়। আটকে পড়া আতঙ্কিত আরও ৬৫০ জন জাপানিও ফিরে যেতে চায়। জাপান তার ইচ্ছুক নাগরিকদের জন্য আরও ফ্লাইট চালুর পরিকল্পনা করছে। রেডিও জাপান জানাচ্ছে, চীনফেরত নাগরিকদের মধ্যে অনেকেই জ্বর ও কাশিতে ভুগছে। তবে উপসর্গ দেখা না দিলেও ফিরে আসা সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।

ইউরোপের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার জন্য আলাদা দুটো বিমানের চীনে যাওয়ার অনুমতি মিলেছে। প্রথম ফ্লাইটে ২৫০ জন ফরাসি নাগরিক চীন ছাড়বে। এই সপ্তাহের মধ্যে কোরিয়া তাদের ৭০০ নাগরিককে ফিরিয়ে নেবে। চীনফেরত কোরীয়দের মধ্যে এ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে চারজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী লট মরিসন বলেছেন, তাঁর দেশের নাগরিকদের দুই সপ্তাহের জন্য ক্রিসমাস আইল্যান্ডে রাখা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পর অস্ট্রেলিয়া সিরিয়াল পেতে যাচ্ছে। অবশ্য স্কটের ঘোষণার পর সমালোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে খোদ অস্ট্রেলিয়ায়ই। কথিত দ্বীপটি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই শিবিরগুলোর দশা বেহাল এবং এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

বর্তমানে সেখানে চার সদস্যের একটি শ্রীলঙ্কান পরিবার রয়েছে। কিন্তু প্রায় এক হাজার মানুষকে ধারণ করার জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকদের পাশাপাশি নিজেদের ৫৩ জন নাগরিককে ফিরিয়ে আনতে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে একযোগে কাজ করছে নিউজিল্যান্ড।

আমাদের ছেলেমেয়েরা কবে ফিরবে?
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার কাজের সম্পর্ক (ওয়ার্কিং রিলেশন) চমৎকার। ভারতের সঙ্গে এ ধরনের একটা কাজের সম্পর্ক জোরদার থাকলে মুম্বাই থেকে উড়ে যাওয়া তাদের উড়োজাহাজেই আমাদের আটকে পড়া ছেলেমেয়েগুলো ফিরে আসতে পারত। ভারতও বলেছে, দেশে এনেই তাদের নাগরিকদের বাড়ি পাঠানো হবে না। দুই সপ্তাহ পর্যবেক্ষণের পর ছাড়া হবে। আমাদের পররাষ্ট্রবিষয়ক বড় মন্ত্রীও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে সে রকম ইঙ্গিতই দিয়েছেন। ‘ফিরে এলে আমরাও নজরে রাখব’ বলে তিনি জানিয়েছেন। তবে চীনারা যে এখনো আমাদের আবেদনের জবাবে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ কিছুই বলেনি। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাচার—কিছু করতে পারছেন না। এদিকে চীনে আটকে পড়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির। কিন্তু মন্ত্রী বলেছেন অন্য কথা। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘তবে অনেকে ফিরতে আগ্রহী নন। তাঁরা বলছেন, এ অবস্থায় দেশে ফেরা ঠিক হবে না। কারণ, ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সব ধরনের চিকিৎসাসেবা চীন দিচ্ছে। বাংলাদেশে এলে কী ধরনের সেবা পাবেন, সেটা বলা মুশকিল।’

তবে কি আমরা দায় এড়ানোর পথ খুঁজছি
মন্ত্রী বলেছেন, দেশে ফিরতে চাওয়া বাংলাদেশিদের তালিকা করা হচ্ছে। তাদের নিবন্ধন শুরু হয়েছে। কবে শুরু কবে শেষ, সেটা নিয়ে ভাগ্যিস কেউ প্রশ্ন করেনি। প্রশ্ন করেননি, দুই সপ্তাহ আলাদা রাখার পরিকল্পনাটা কী? কোথায় তাদের রাখা হবে? কোন হাসপাতালে? নির্দেশটা কোথা থেকে আসবে। নাকি অস্ট্রেলিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদের ‘ক্রিসমাস আইল্যান্ড’ ভাসানচরে নেওয়া হবে তাদের? আমাদের ছেলেমেয়েদের আনার আগে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে ও জানাতে হবে। বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বাজারে, রাস্তায়, প্রার্থণাস্থলে একসঙ্গে অনেক মানুষ জড়ো হন। চিন–ফেরতদের এসব স্থান এড়িয়ে চলা নিশ্চিত করা হবে কী করে? পরিবার যতই আকুল হোক, চিনে থাকা বাংলাদেশিরা যা-ই বলুন, এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কার্যধারা অনুযায়ী।

অভিজ্ঞতা থেকে ধারনা করা যায়, ‘সময় অথবা লোকবলের অভাবে’ আমাদের কোনো দূতাবাসে অথবা কনস্যুলেটে সে দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের হালনাগাদ কোনো তালিকা আছে কি? প্রবাসে যাওয়ার পর প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে নিজ নিজ দূতাবাসকে অবস্থানের ঠিকানা জানিয়ে রাখা। অনলাইনের যুগে এটা করা কোনো ব্যাপার না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না। যাঁরা আগে ঘটিয়েছেন, তাঁরা আর উৎসাহ পান না। কেন কেউ নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে দূতাবাসে যান না, কেন যোগাযোগ রাখেন না, সে আরেক কাহিনি। দূতাবাসের কর্মকর্তারা যেমন হোন না কেন, বিদেশে অবস্থানরত সবার উচিত জেলা–উপজেলা সমিতিতে সময় না দিয়ে দূতাবাসকেন্দ্রিক যোগাযোগটাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। দায় এড়ানোর দরজাগুলোর কপাট লাগিয়ে দেওয়া।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]