চট্টগ্রামে পাহাড় নিঃশেষ

উন্নয়নের লক্ষ্য কী—এ প্রশ্নের জবাব কাগজে-কলমে যা-ই হোক, বাস্তবতা হলো পরিবেশকে অগ্রাহ্য করে অবকাঠামো আর অর্থভান্ডারের বৃদ্ধিকেই অভীষ্ট বানিয়েছে দেশের বিভিন্ন ‘উন্নয়নশীল’ কর্তৃপক্ষ। অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন, বাস্তুতন্ত্রকেন্দ্রিক পরিকল্পনা ইত্যাদি প্রণয়ন ও দেখভালের জন্য যেসব কর্তৃপক্ষ আছে, তারা নিজেরাই যখন পরিবেশবিনাশী একেকটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, তখন হতাশ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা নিয়ে গতকাল প্রথমআলোয় যে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তা নগর উন্নয়ন এবং পরিবেশ–সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর অভীষ্টকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট।

একটি প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের এলাকার ৫৭ শতাংশ পাহাড় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতার পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের ৮৮টি পাহাড় পুরোটাই বিলুপ্ত হয়েছে। একই সময়ে আংশিক কাটা হয়েছে ৯৫টি। এরপরের ১২ বছরে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিয়েছে। বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি প্রভাবশালী ব্যক্তি, আবাসন ব্যবসায়ী, ইটভাটার মালিক, রাজনীতিকেরা এসব পাহাড় নিধন করছেন। অন্য প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে পাহাড় নিধনে শামিল হওয়া থেকে বাদ যায়নি সরকারি সংস্থাও। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) পাহাড় কেটে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ বোস্তামী সংযোগ সড়ক নির্মাণ করেছে। পাহাড় কেটে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করায় সিডিএর একটি প্রকল্পকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ টাকা জরিমানা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে অভিযোগের ভিত্তিতে পরিবেশ অধিদপ্তর সিডিএর ঢাকা ট্রাঙ্ক রোড ও বায়েজিদ বোস্তামী সংযোগ সড়ক প্রকল্পটিকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেছিল। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে বেশ কিছু শর্তের বিনিময়ে জরুরি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে সিডিএকে আড়াই লাখ ঘনমিটার পাহাড় কাটার অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকল্প থেকে কাটা হয় সাড়ে ১০ লাখ ঘনমিটার পাহাড়। শুধু তাই নয়, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে যেসব শর্ত দেওয়া হয়, তার বেশির ভাগই ভঙ্গ করে তারা।

চট্টগ্রাম নগরের মধ্যে এত দিনে যে ৫৭ শতাংশ পাহাড় ‘নাই’ করে দেওয়া হলো, তার দায় প্রধানত সিডিএ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ওপর পড়ে। অন্য ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ ঠিক রেখে উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য যে সংস্থা নিয়োজিত, তারাই পাহাড় সাবাড় করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। উন্নয়নশীল দেশের রূঢ় বাস্তবতার কারণে কারখানা, রাস্তাঘাট দরকার। কিন্তু তা গড়তে গিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করলে চলে না। যে পাহাড়গুলো ধ্বংস করা হচ্ছে তার ক্ষতি জরিমানা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। স্বীকার্য যে প্রগতির রথ দ্রুত ধাবমান। কিন্তু তারও আগে স্বীকার করতে হবে, প্রকৃতিকে ভুলে উন্নয়ন হয় না।