বিএনপি মাঠে ছিল, এটা মন্দের ভালো

শান্তনু মজুমদার
শান্তনু মজুমদার
আজ ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বিরোধী দল বিএনপি মাঠে ছিল, এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার। এটাকে বিএনপির রাজনৈতিক পরিপক্বতার লক্ষণ হিসেবে দেখছেন তিনি। একে এই ভোটের মন্দের ভালো দিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি। অন্যদিকে নির্বাচনে কম ভোট পড়াকে একটা দুর্বল দিক বলে তার মনে হয়েছে। শুধু দোষারোপের মধ্যে না থেকে তম ভোটের এই প্রবণতার কারণ সন্ধানে পেশাদারি ব্যাখ্যার ওপরে গুরুত্ব দিচ্ছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

প্রথম আলো: এবারের দুই সিটি নির্বাচনে বেশ কম ভোট পড়েছে, কীভাবে দেখছেন?

শান্তনু: আমার কাছে মনে হয়, একটা দিক হলো জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় জনগণের মধ্যে উৎসাহ কম দেখা গিয়েছে। গত কয়েক বছর যাবৎ যে নির্বাচনী সংস্কৃতি চলছে তার কারণে মানুষের উৎসাহ কমে যেতে পারে। আরেকটি কারণ হতে পারে, জাতীয় নির্বাচনকে মানুষ যত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এ নির্বাচনকে তারা সেভাবে নিতে পারেনি। তবে দুই কারণের মধ্যে প্রথমটিই আমার কাছে বেশি জোরালো বলে মনে হয়। এছাড়াও মেয়র প্রার্থীদের একঘেয়ে অঙ্গীকারগুলোও ভোটারদের মধ্যে একধরনের ঔদাসীন্য নিয়ে আসে বলে মনে হয়।

প্রথম আলো: কি রকম?
শান্তনু: আমার মনে হয় যে দলের পক্ষ থেকে হাতে বেশ কিছুটা সময় থাকতেই মেয়র প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে দিলে ভালো হয়। এতে করে তাঁরা তাদের অঙ্গীকারগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সময় পাবেন। চাইলে তখন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আগাম কিছু পরামর্শ করে নিতে পারবেন। এখন তাঁরা যেসব অঙ্গীকার করে সেগুলো খুব চটজলদি ভাবনার ফসল। এগুলো বিশদে তাদের কাছে থেকে পাওয়া যায় না। পাওয়া সম্ভবও না। কেউ মশামুক্ত ঢাকা উপহার দেবেন, কেউ ঢাকার চারপাশে এটাওটা করবেন। এগুলো একেবারেই তাৎক্ষণিক। প্রার্থীরা এগুলো ধারণও করেন না। এগুলোর পেছনে তাদের কোনো পেপার ওয়ার্ক নেই এটা মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। মেয়রদের অঙ্গীকারগুলো আমার কাছে কখনো-কখনো স্কুলপড়ুয়াদের মতো মনে হয়। এসব অঙ্গীকার জনগণ সিরিয়াসলি নেয় বলে আমার মনে হয় না। এ নির্বাচনকে ঘিরে গণমাধ্যমের ট্রিটমেন্টও ত্রুটিপূর্ণ।

প্রথম আলো: গণমাধ্যম, কীভাবে?
শান্তনু: গণমাধ্যমে মেয়র প্রার্থীদের যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয় তার চেয়ে অনেক কম গুরুত্ব পায় কাউন্সিলর প্রার্থীরা। অথচ স্থানীয় রাজনীতি বোঝার জন্য এরাই গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা ঘরে ঘরে যান। তাঁদের নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া উচিত।
প্রথম আলো: এবার শাসক দল ও বিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচারে কোনো ভিন্নতা খুঁজে পেয়েছেন?
শান্তনু: দুই দলের প্রচার বা ইশতেহারে ব্যতিক্রমী কিছু খুঁজে পাইনি। একেবারে গৎবাঁধা কথা। তাদের বক্তব্যের মধ্যেও ভিন্নতার লক্ষণ দেখিনি। নির্বাচনটা আমাদের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ কোনো পরিবর্তন আনবে না বলেই মনে করি।

প্রথম আলো: নির্বাচন যাই হোক, কোনো অর্জনই কী নেই এর?
শান্তনু: নির্বাচনে বড় অর্জন হলো বিরোধী দল নির্বাচনে থেকেছে। এটা মন্দের ভালো। বিরোধী দল এটা বুঝতে পারছে যে, শাসক দলের সঙ্গে লড়তে হলে নির্বাচন হচ্ছে উত্তম বিকল্প। যত অভিযোগ থাকুক তারা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। এটা তাদের পরিপক্বতার প্রমাণ।

প্রথম আলো: নির্বাচনে প্রচারকালীন এমন কোন পরিস্থিতি কি তৈরি হয়েছিল যাতে মানুষ কম এসেছে?
শান্তনু: নির্বাচনী পোস্টার ছিঁড়ে ফেলা বা হুমকি-ধমকির কিছু বিচ্ছিন্ন খবর এসেছে। কিন্তু বড় আকারে কিছু হয়েছে তা হয়তো কেউ বলবে না। আজ ভোটের দিনও কাউকে জোর করে কেন্দ্রে আসতেই বাধা দেওয়া হয়েছে, এমন ঘটনাও হয়তো খুব বেশি নেই। তাহলে সমস্যাটা কোথায়, খুঁজে বের করা দরকার। সরকার তার জনপ্রিয়তা নিয়ে যে কথা বলে বা বিরোধী দল সরকাররে জনপ্রিয়তা হীনতা নিয়ে যা বলে—দুটোই অসাড় প্রমাণ হয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ যদি বিরোধী দল যেই মাত্রায় দাবি করে সেই মাত্রায় হতো তবে মানুষ ব্যাপকভাবে এসে ভোটে তা দেখাতে পারত। আবার সরকারের উন্নয়নে যদি জনগণের মধ্যে খুশির জোয়ার বইতেই থাকে তাহলেওতো ভোটদানের হার আরও বেশি হওয়ার কথা।

প্রথম আলো: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে ভোটের এই নতুন ধারা কেমন করে দেখছেন?
শান্তনু: ভোট গণতন্ত্রের প্রধানতম শর্ত কিন্তু একমাত্র নয়। ২০১৪ সালের পর থেকে নির্বাচনের রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হয়েছে। এটি উঠতে সময় লাগবে। কাউকে দোষারোপ করে কাজ হবে না। সরকার হয়তো বিরোধী দলকে দায়ী করল আবার বিরোধী দল সরকারি দলকে দায়ী করল—এভাবে ব্লেমগেমে বিষয়টির সুরাহা হবে না। সুশীল সমাজের একটি অংশের ব্যাখ্যা একেবারে গৎবাঁধা হয়ে গেছে।

২০১৪ সালে নির্বাচনী সংস্কৃতি লাইনচ্যুত হওয়াটাকে নির্মোহভাবে ব্যাখ্যা করার ব্যাপার আছে। সেই ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে নির্বাচনকে শুধু নির্বাচন দিয়ে বোঝা যাবে না। ২০১৪কে একটা নির্বাচন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। ২০১৪ এর নির্বাচনকে ২০১৩ দিয়ে বুঝতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সেই সময় শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ, দ্বিতীয়ার্ধে শাপলা চত্বর এরই ধারাবাহিকতায় নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের রাজনীতিকে ব্যাখ্যার দরকার আছে। আবার এরই ধারাবাহিকতায় আছে বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন এবং সরকারি দলের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার যুক্তি। এভাবে দেখলে দেখা যাবে আমরা একটা জায়গায় পৌঁছে গেছি।